এক প্রতিবন্ধী মায়ের কান্না ও আমাদের সামাজিক দায়বদ্ধতা

সিটিভি নিউজ।।      শাহাজাদা এমরান।। =লেখক ও কলামিস্ট==
৪ সেপ্টেম্বর ২০২২। সাত সকালে অফিসে চলে গেলো জীবনবন্ধু। ২০ মিনিটের ব্যবধানে স্কুলে চলে গেলো আবির-দিবাও। আমি প্রস্তুত হয়ে বসে আছি অফিসে যাওয়ার জন্য। তখনো ঘড়ির কাটা নয়টার ঘরে এসে পৌঁছেনি।নগর কুমিল্লার টমছমব্রিজ এলাকায় মুশলধারে বৃষ্টি হচ্ছে।এমন সময় সেল ফোনটা বেজে উঠল।রিসিভ করতেই মায়াবি এক নারী কন্ঠ ভেসে এলো..।শাহাজাদা এমরান সাহেব বলছেন,জি বলছি।আপনি কি বুদ্ধি প্রতিবন্ধী ও অটিস্টিক স্কুল কুমিল্লার যুগ্ম সম্পাদক, জি । আমি ঢাকা থেকে এসেছি।সুইড-বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় অফিসের মহাসচিব মামুন ভাই আপনার নাম্বারটা দিয়েছে। আমি কি একটু আপনার সাথে দেখা করতে পারি।অত্যন্ত ধীর ও কোমল কন্ঠে কথা বলছেন তিনি। আমি বললাম,কেন আমার সাথে দেখা করতে পারবেন না। অবশ্যই পারবেন। বৃষ্টি কমলেই আমি অফিসে যাব ।আপনি কষ্ট করে আমার অফিসে আসেন। তিনি বললেন, আমি তো ঝাউতলা আছি,আপনি আপনার অফিসের ঠিকানাটা মেসেজ করে পাঠান প্লিজ। জি আচ্ছা বলে ফোনটা রেখে মেসেজটা পাঠিয়ে দিলাম।

বৃষ্টি কিছুটা কমলে সকাল সাড়ে নয়টার দিকে অফিসে আসি। ভদ্র মহিলা আমাকে পোনে দশটায় ফোন করে নিশ্চিত হলেন আমি দৈনিক আমাদের কুমিল্লা অফিসে এসে পৌঁছেছি কিনা। তিনি ঠিক দশটায় অফিসে এলেন।
অত্যন্ত পরিমার্জিত ও শালিনতাবোধ সম্পন্ন পোষাক পড়ে , দড়জায় দাঁড়িয়ে অনুমতি নিয়ে তিনি সালাম দিয়ে আমার রুমে প্রবেশ করলেন। ভদ্র মহিলার ফোনে কথাপোথনে আমার মনে হয়েছিল, মধ্য বয়সের হবেন । কিন্তু বাস্তবে উনাকে দেখে আমার মনে হলো ৫৫ থেকে ৬০ বছর বয়স হবে। উনাকে প্রথম দর্শণেই আমার শিক্ষিত,ভদ্র ও অমায়িক ব্যক্তিত্বের অধিকারী মনে হলেও তাঁর মুখায়বে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে রাজ্যের ক্লান্তির ছাপ।মনে হলো তিনি বিশাল এক কষ্টের জীবন ধারণ করেন। হয়তো কোন সংবাদ বিষয়ক ব্যাাপরে আমার কাছে আসছেন।

প্রাথমিক সৌজন্যতা দেখিয়ে সহকর্মী জয়কে চা খাওয়াতে বলে জানতে চাইলাম বোন বলেন আমি আপনার কোন উপকারে আসতে পারি। কথার শুরুতেই মুখের মাস্কটা খুলে তার বেদনাদায়ক জীবনের করুণ গল্প গুলো বলতে শুরু করলেন। এর মধ্যে দিয়ে বেরিয়ে আসতে লাগল, আমাদের পারিবারিক, সামাজিক তথা জাতীগত ভাবে অবক্ষয়,অপসংস্কৃতি ও কুসংস্কারগুলো।

একজন সন্তান ধরনীতে আগমন করে মহান আল্লাহর রহমতে আর বাবা-মা’র সম্মিলিত প্রচেষ্টায়। সন্তান ভালো হবে ,না প্রতিবন্ধী হবে ,না বিকালাঙ্গ হবে এটা একমাত্র ¯্রষ্টার হাতে। পৃথিবীর কোন মা-ই যেমন চায় না তার প্রিয় সন্তান প্রতিবন্ধী বা বিকালাঙ্গ হোক। তেমনি বাবাও না। একজন মুুসলিম হিসেবে বিশ^াস করতে চাই এটা সম্পূর্ন ¯্রষ্টার হাতে। যেখানে সৃষ্টির কোন কিছু করার বা বলার থাকে না। সন্তান মেয়ে হবে না ছেলে হবে এটাও বিধাতার হাতে। কিন্তু আমাদের দেশে মেয়ে সন্তান হলে কিংবা প্রতিবন্ধী বা বিকালাঙ্গ সন্তান হলে সব দায় এসে পড়ে সংশ্লিষ্ট মায়ের উপর। এখানে মায়ের অপরাধ কি ? শুধু বাংলাদেশ না , তামাম পৃথিবীর কোন মা কি চায় তার সন্তান অটিষ্টিক, প্রতিবন্ধী বা বিকালাঙ্গ হোক। এই চাওয়ার জন্যই কি তিনি দশ মাস দশ দিন গর্ভে ধারণ করেছিলেন প্রিয় সন্তানকে।

এখানেই আমার প্রশ্ন, এটা যদি মায়ের অপরাধ হয় তাহলে বাবার হবে না কেন ? সন্তান জন্মদানে কি বাবার কোন ভুমিকা ছিল না? এটা তো হযরত ঈশা(আ:) এর মা হযরত মরিয়ম বিবি না যে, স্বামী ছাড়া মহান আল্লাহর ঐশরি¦ক ক্ষমতায় তিনি মা হয়েছেন।

ভদ্র মহিলার সাথে কথা বলে জানতে পারলাম যে, আসলে তিনি খুব বেশী বয়সী নন। তিনি আমার এসএসসি’র ইয়ারম্যান। ১৯৯২ সালে কুমিল্লা নগরীর ফরিদা বিদ্যায়তন থেকে এস এস সি পাস করেছেন। পরবর্তীতে পড়াশুনা ও সংসার জীবন এবং বর্তমান বসবাস সব কিছুই ঢাকায়। কুমিল্লা তার বাবার বাড়ি।

জানতে পারলাম, একজন ব্যবসায়ীর স্ত্রী তিনি। দুই ছেলের জননী । বড় ছেলের বয়স ২০ বছর। সে একজন অটিষ্টিক আর ছোট ছেলে ঢাকায় ষষ্ট শ্রেনীতে পড়ে।

জেনে নিলাম, স্বামী,শ^শুর,শাশুরি,ননদ,দেবর ও ভাসুরদের নিয়ে ছিল তার যৌথ পরিবার। সংসারে অভাব অনটন যেমন ছিল না তেমনি সুখ শান্তির কোন অভাব ছিল না। কিন্তু বিপত্তি বাধে ২০০২ সালে যখন তার বড় ছেলেটি জন্ম নেয়। জন্মের কয়েক মাস পরেই বুঝতে পারেন তিনি একটি বিশেষ শিশু(অটিষ্টিক) জন্মদান করেছেন। ব্যস, ক্ষনিকের মধ্যেই বাড়ির পরিবেশ বদলে যেতে লাগল। শ^শুর বাড়ির সবাই এ জন্য দায়ী করতে লাগল এই নারীকে। দুধের মত ফর্সা গড়নের নারীটিই এখন তাদের চোখে কুৎসিত, কদাকার। যেন তার দিকে ফিরিয়েও তাকানো যায় না। একবারও তারা ভেবে দেখল না , যে মা দশ মাস দশ দিন এই বিশেষ শিশুটিকে পেটে ধারণ করল তার মনের অবস্থাটি। উঠতে,বসতে,চলতে ,ফিরতে খোঁচা দিত। এই নানা গুণে গুন্বানিত নারীটিই হয়ে গেল বড্ড অপয়া। স্বামী নামের অবলম্বনকারী বটবৃক্ষটি নিজে স্ত্রীকে দায়ী না করলেও স্বজনদের অপবাদের কোন প্রতিবাদ করার মত ব্যক্তিত্ব দেখাতে পারেননি। তাই শুধু প্রতিবন্ধী সন্তান জন্মদানের কারণে যৌথ পরিবারটি ভেঙ্গে গেল। সব দায় মাথায় নিয়ে প্রিয় সন্তানটিকে বুকে জড়িয়ে বের হয়ে পড়লেন যৌথ পরিবার থেকে।
গত বিশ বছর ধরে এই বিশেষ শিশু( অটিষ্টিক)টিকে লালন পালন করতে গিয়ে কি পরিমান যে তার কষ্ট হয়েছে , তার মাত্র সামান্য অংশ বলতে গিয়েই বার বার কান্নায় ভেঙ্গে পড়া এই দূ:খিনী মা জানালেন, আমরা তিন বোন যখন একত্রে বের হই তখন সবাই আমার বড় দুইবোনকে বলে,আমি তাদের বড় বোন। আমার বড় বোনদের এখনো চুল পাকেনি অথচ ৯২ সালে এস এস সি পাস করা মেয়ে আমি। যে দেখে সেই মনে করে আমার বয়স ৫০ বছরের উপর। কান্না জর্জরিত কন্ঠে বলেন, ১৪/১৫ বছর বয়স পর্যন্ত আমার ছেলের বাথ রুমের কাজটি পর্যন্ত আমার নিজ হাতে করে দিতে হয়েছে। জীবন থেকে কত শত শত নির্ঘুম রাত কেটেছে তার কোন হিসেব নেই। গত ২০ বছরে কত শত সামাজিক অনুষ্ঠান আমি মিস করেছি ছেলেকে নিতে পারব না বলে। দিন রাত ২৪ ঘন্টা চোখের পানি শাড়ির আঁচল দিয়ে মুছতে মুছতে এখন আর পানি চোখে খুঁজে পাওয়া যায় না। যার ঘরে একটা অটিষ্টিক শিশু আছে একমাত্র আল্লাহ ছাড়া সেই মা ই জানবে কত নির্মম নি:শদ্ধ যন্ত্রনা সহ্য করতে হয়। অটিষ্টিক শিশুর বাবারা হয়তো অনেকটাই জানবে না। কারণ, বাবা তো কর্মক্ষেত্রে সকালে যায় অনেক রাতে আসে। কোন কোন অটিষ্টিক সন্তানের বাবা ব্যস্ততার নাম করে বাসা থেকে ভোরে চলে যায় ফেরে মধ্য রাতে। যাতে ঐ সন্তানের যন্ত্রনা তাকে দেখতে না হয়। আর মা ! মা তো এই ফাঁকিটা দিতে পারে না। সন্তান সুস্থ কিংবা অসুস্থ হোক । মায়ের কাছে তো সব সন্তানই সমান।

ভদ্র মহিলা বললেন, এমরান ভাই, সব কিছু মিলিয়ে আমিতো একটা মানুষ। এত কষ্ট , এত যন্ত্রনার পর নিজের স্বজনরা যখন খোঁটা দিয়ে কথা বলে তখন আর বাঁচতে ইচ্ছে করে না। কিন্তু মরতেও পারি না। কারণ, আমি না থাকলে আমার এই সন্তানকে কে দেখবে ? তার জন্য হলেও আমাকে আরো বেঁচে থাকতে হবে।

সব শেষে জানালেন আমার কাছে তার আসার উদ্দেশ্য। বললেন, ঢাকায় শুনেছি কুমিল্লায় একটি প্রতিবন্ধী ও অটিষ্টিক স্কুল আছে। কুমিল্লা আমার বাড়ি। তাই আমার এলাকার প্রতিবন্ধী শিশুদের কল্যাণে আমি অবদান রাখতে চাই। সাথে সাথে উনাকে আমি স্কুলে নিয়ে গেলাম। ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক তাহমিনা ম্যাডামের সাথে পরিচয় করালাম। কুমিল্লা বুুদ্ধি প্রতিবন্ধী ও অটিষ্টিক বিদ্যালয় এর ব্যবস্থাপক জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশন এর আজীবন সদস্য করে নিলাম। বিদায় নেয়ার আগে তৃপ্তির হাসি দিয়ে বললেন, এমরান ভাই, আজ থেকে আপনাদের সাথে থেকে আমার কুমিল্লার প্রতিবন্ধী ও অটিষ্টিক শিশুদের কল্যাণে কিছুটা হলেও উপকারে আসতে পারবে এই সুখ স্মৃতি নিয়ে আজ ঢাকায় ফিরব।

আমি কয়েকমাস আগেও প্রতিন্ধী ও অটিষ্টিক বাচ্চাদের নিয়ে একটি কলাম লিখেছিলাম। সেই লেখাতেও বলছি, আজ আবার বলছি, প্রতিন্ধী ও অটিষ্টিক শিশুদের বোঝা না ভেবে সম্পদ ভাবুন। আমাকে আপনাকে যে আল্লাহ বানিয়েছেন তাদেরকেও একই আল্লাহ তৈরী করেছেন। তারাও এই সমাজের অন্য দশটা শিশুর মতই আলো বাতাসে বেড়ে উঠতে চায়। আমাদের সংবিধান দেশের সকল নাগরিককে সমান অধিকার দিয়েছে। কিন্তু আমরা কেন তাদের অবহেলা আর অনাদরে রাখব। একজন প্রতিন্ধী ও অটিষ্টিক শিশু জন্মদানে কোন ভাবেই মা বাবা দায়ী হতে পারে না। আর মা-কে একক ভাবে দায়ী করা শুধু অপরাধ না , ক্ষমার অযোগ্য শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

একজন প্রতিন্ধী ও অটিষ্টিক শিশু জন্ম দিয়েছে বলেই মা-কে অপয়া,অলক্ষী বলে অপবাদ দিবেন না। এই অবক্ষয়,অপসংস্কৃতি ও কুসংস্কার থেকে আমাদের বেড়িয়ে আসতে হবে। প্রতিন্ধী ও অটিষ্টিক শিশুর মা যখন আপনার ছেলের স্ত্রী কিংবা আপনার ভাইয়ের স্ত্রী বলে আপনি তাকে অপয়া বলছেন , একটু খেয়াল করুন, আপনার মেয়ে কিংবা বোন যদি প্রতিন্ধী ও অটিষ্টিক শিশু জন্ম দেয় তখন তার শশুর বাড়ির লোকেরা যদি একই কথা বলে তখন আপনাদের কেমন লাগবে। এই সামান্য বিচারবোধ নিজের মধ্যে জাগ্রত করুন।

প্রতিবন্ধী শিশুদের অবহেলা,অনাদার আর নয়, তাদের আদর সোহাগ দিয়ে সমাজে বেড়ে উঠতে সাহায্য করুন। তাদের মা-বাবাকে প্রতিন্ধী ও অটিষ্টিক শিশুর মা বাবা হিসেবে ট্রিট করবেন না। মহান আল্লাহ আমাদের সবার মানবিকবোধ সম্পন্ন বিবেক প্রতিন্ধী ও অটিষ্টিক শিশুদের কল্যাণে নিবেদিত করুক এটাই এই লেখার মুল উদ্দেশ্য।

লেখক, সাংবাদিক,সংগঠক, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক লেখক ও যুগ্ম সম্পাদক, কুমিল্লা বুদ্বি প্রতিবন্ধী ও অটিষ্টিক বিদ্যালয় (সুইড বাংলাদেশ।
০১৭১১-৩৮৮৩০৮ ,‍sahajadaamran@yahoo.com,   লেখক : সাংবাদিক,সংগঠক ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক লেখক।

সংবাদ প্রকাশঃ  ০৬-০-২০২২ইং সিটিভি নিউজ এর  (সংবাদটি গুরুত্বপূর্ণ মনে হলে দয়া করে ফেসবুকে লাইক বা শেয়ার করুন) (If you think the news is important, please share it on Facebook or the like  See More =আরো বিস্তারিত জানতে ছবিতে ক্লিক করুন=  

(সংবাদটি গুরুত্বপূর্ণ মনে হলে দয়া করে ফেসবুকে লাইক বা শেয়ার করুন)
(If you think the news is important, please like or share it on Facebook)
আরো পড়ুনঃ