কুমিল্লার বর্ষিয়ান নেতা আফজল খানকে কাছ থেকে আমার দেখা

সিটিভি নিউজ।।     ॥ শান্তনু হাসান খান ॥ সংবাদদাতা জানান ===
মানুষ মরণশীল। মৃত্যুকে অতিক্রম করার ক্ষমতা মানুষের নেই। নশ্বর দেহ পৃথিবী থেকে বিদায় নেয়, মানুষ বেঁচে থাকে তার কর্মে। অধ্যক্ষ আফজল খানও আমাদের মাঝে বেঁচে থাকবেন তাঁর কর্মগুণে। ভালো-মন্দ আপেক্ষিক বিষয়, পছন্দ-অপছন্দ রাজনীতির স্বাভাবিক বিষয়। আফজল খানও হয়তো ভালো-মন্দ, পছন্দ-অপন্দের উর্ধ্বে ছিলেন না। কিন্তু তিনি ছিলেন সত্যিকার অর্থে তৃণমূল থেকে উঠে আসা নিবেদিত এক রাজনৈতিক কর্মী।
কুমিল্লায় আওয়ামী লীগের জন্মের সাথে জড়িয়ে আছেন তাঁর চাচা মোসাদ্দেক আলী খানের নামটিও। আফজল খান যখন ছাত্রলীগের সাথে সম্পৃক্ত হন তখন কুমিল্লায় ছাত্র ইউনিয়নের রমরমা অবস্থা। অপর দিকে এনএসএফ এর অত্যাচার। আফজল খান, সৈয়দ রেজাউর রহমান, রফিকুর ইসলাম মিয়া তখন ছাত্রলীগকে সংগঠিত করার কাজে আত্মনিয়োগ করেছিলেন। সাথে ছিলেন অধ্যক্ষ আবদুর রউফ এবং মফিজুর রহমান বাবলু। তিনি নেতা মানতেন হাবিব উল্লা চৌধুরীকে। প্রত্যেক পাড়ায়, মহল্লায়, ইউনিয়নে তথা পুরো কুমিল্লা জুড়ে সংগঠনকে সংগঠিত করলেন আফজল খান। সংগঠন করতে যেয়ে বঙ্গবন্ধুর সানিধ্যে আসেন। আর সেই সময় বঙ্গবন্ধু যখনই কুমিল্লায় আসতেন তখন বোলতেন- আমার আফজাল কই? তিনি একজন ভালো মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি আমাকে বলেন-“কটকবাজারের যুদ্ধের কথা আমার বেশ মনে পড়ে। সেই সময় আমরা দুই নম্বর সেক্টরে হাতিমারা ক্যাম্পের দায়িত্বে ছিলাম। একসময় বিবিরবাজার সীমান্তের উল্টো দিকে এক সন্ধ্যায় পাক-হানাদার বাহিনীকে আক্রমনের জন্য আমরা কয়েকজন এম্বুসে ছিলাম। রাতে পাক বাহিনীরা বিবির বাজার থেকে ত্রিপুরা সীমান্তের দিকে এগুচ্ছিলো। কালো বোরকা পরে সে পথ দিয়ে আসছিলো মুক্তিবাহিনীকে আক্রমন করতে। আমরা তাদের উপস্থিতি টের পেলাম। আর তখনই ফায়ার-। আমাদের হাতে কয়েকটা এসএলআর/এস এমজি আর ২টা মাত্র এলএমজি। সারারাত ফায়ারিং হলো দু’পক্ষে। পাক-হানাদাররা মর্টার শেলিং করলো। তারপরেও আমরা এম্বুশ ছাড়িনি। সারারাত ব্যাংকারেই ছিলাম। আজানের পরে দেখা গেলো কনভয় ভরে পাক সেনারা আহত নিহত অবস্থায় ফিরে যাচ্ছে কুমিল্লা ক্যান্টের দিকে। পরে আমরা ওদের ব্যাংকার দখল করলাম।”
অনেক স্মৃতির কথা বলছিলেন মুক্তিযোদ্ধা আফজল খান। আমরা দুজন-আমি আর ওমর ফারুক তপস ওই দিন তাঁর সাথে ছিলাম। পাশে বসে ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার শফিউল আহমেদ বাবুল ভাইও। অনেক স্মৃতির পরে তাঁর সে পুরাতন সবুজ জীপে চড়ে শহরে ফিরে আসলাম। বিক্ষিপ্ত কথাগুলো দম দেয়া রেকর্ডের মতো থেমে থেমে বলছিলেন ৭১’র সে স্মৃতিগুলো। এর কয়েক বছর পরে ৯০ দশকের গোড়ার দিকে গণ অভ্যুত্থানের সময় কান্দিরপাড় মোড়ে সকাল বিকাল পিকেটিং চলতো। আর সে সময় আমরা যারা ছবি তুলতাম তার মাঝে বাকিন রাব্বী, সাদেক, ওমর ফারুক তাপস, নওশাদ কবীর, শাহজাহান চৌধুরী, বদিউল আলম দুলাল, সাদেক মামুন আর রেজাউল করিম শামীম-সবার সাথে খান সাহেবের একটা সুসম্পর্ক ছিল। শামীমের তোলা অনেক ছবি ইতিহাস স্বাক্ষী দেয়। পিকেটিং এর সময় সকাল-বিকাল পাইকপাড়া স্টোর, নিরূপমা ও হাজী স্টোরের সামনে লম্বা টুলে তখনকার নেতারা বসতেন। তাদের মাঝে মুজিব ভাই, রুস্তম ভাই, পাখি ভাইসহ অনেক সিনিয়র জুনিয়র লিডারগণ দিক নির্দেশনা দিতেন। একদিন খুব সকালে আমাকে ডেকে বললেন, এই ছোট খান সাহেব- শ্যামলের দোকান থেকে এ ৫০ টাকার লুচি নিয়ে আসেন। আমরা সবাই ভাগযোগ করে খাই।
খান সাহেবের সাথে আরো গভীরভাবে মিশলাম তখনই- একদিন সন্ধ্যায় মডার্ণ স্কুলে আবদুল হাই বাবলু আমাকে ধরে নিয়ে গেলেন খান সাহেবের কাছে। খান সাহেব হাত মিলিয়ে বললেন, আপনি বাবুল ভাইয়ের বইন জামাই। আজ থেকে আপনিও আমার বইন জামাই। আমি ময়নামতি বের করবো। আপনি থাকবেন। আপনাকে বেতন দেয়া যাবে না। শুধু গাড়ীভাড়া দিবো। আর কিছু না। কাল থেকে ময়নামতির জন্য লেগে যান। যে কথা সে কাজ। অবশেষে আমি ময়নামতির প্রথম নির্বাহী সম্পাদকের দায়িত্ব নিলাম। অনেক ঝড় ঝাপটার মধ্য দিয়ে ওয়ান এলিভেন পাড় করলাম। আর সে সময়ে আবদুল হাই বাবলু ভাই সব ধরনের সহযোগিতা করে ময়নামতিকে টিকিয়ে রাখলেন। খান সাহেবের সাথে সাংবাদিক মহলের কোন বিরোধ ছিল না। সবাইকে আপন করে নিয়ে নিউজগুলো থ্রো করতেন। একবার টাউন হল ময়দানে সম্ভবত: ১৯৯৬-৯৭ তে তখন আওয়ামীলীগের সম্মেলন হচিছল। সে সময় নির্বাচিত হলে খান সাহেব। পাশাপাশি আকম বাহাউদ্দিন বাহার ভাইও ওই সম্মেলনে অংশ নিয়েছিলেন।
এ ছাড়াও তিনি ১৯৭১ সনের মুক্তিযুদ্ধের একজন সংগঠক ও বীর মুক্তিযোদ্ধা। তিনি হাতিমারা ইয়ূথ ক্যাম্প চীফ হিসেবে দেশের স্বাধীনতা অর্জনে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেছিলেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর হতে তিনি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকে বিভিন্ন সামাজিক কর্মকান্ডে অংশ গ্রহণ করেন। যেমন- প্রথম নির্বাচিত ভাইস চেয়ারম্যান, কুমিল্লা পৌরসভা, সাবেক সভাপতি- বাংলাদেশ সমবায় ইউনিয়ন, পরিচালক- ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স এণ্ড ইন্ডাষ্ট্রি, চেয়ারম্যান-আদর্শ সদর উপজেলা, কুমিল্লা, সভাপতি-কুমিল্লা চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাষ্ট্রি, সহ-সভাপতি- জেলা ক্রীড়া সংস্থা, কুমিল্লা, সভাপতি-জাতীয় ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প সমিতি, নির্বাচিত সভাপতি-বাংলাদেশ সমবায় ব্যাংক লিঃ, ঢাকা, সভাপতি-ল্যান্ড মরগেজ ব্যাংক, কুমিল্লা, সহ-সভাপতি-কুমিল্লা রাইফেলস ক্লাব এবং সম্পাদক ও প্রকাশক-দৈনিক ময়নামতি, কুমিল্লা।
আলহাজ্ব অধ্যক্ষ আফজল খান এ্যাডভোকেট ১৯৭৮ সনে বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট ইউনিটের আজীবন সদস্যপদ লাভ করে সরাসরি রেডক্রস মুভমেন্টের সাথে সম্পৃক্ত হন। পরবর্তীতে ১৯৮৮, ১৯৯৫, ১৯৯৮, ২০০৪ ও ২০০৮ সনে কুমিল্লা জেলার দুর্যোগ কবলিত এলাকায় ইউনিটের পক্ষে দুর্দশাগ্রস্থ অসহায় মানুষের দুর্ভোগ লাঘবে সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সাথে সমন্বয় করে আর্থিক সহায়তাসহ বিভিন্ন প্রকার সহায়তা প্রদান করেছেন। তিনি দীর্ঘদিন যাবৎ ইউনিটের ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়ে অত্যন্ত যোগ্যতার সাথে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন।
কুমিল্লার এ বর্ষিয়ান নেতা সবশেষে কর্মময় জীবন ছিলো বর্ণাঢ্য। ১৪ দলের সমন্বয়ক। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স ছিলো ৭৭ বছর। তিনি স্ত্রী, তিন ছেলে ও এক কন্যা রেখে গেছেন। ১৯৪৫ সালের ১০ ফেব্র“য়ারি কুমিল্লা শহরের রামমালা রোডস্থ তাঁর পৈত্রিক বাড়ীতে জন্ম গ্রহণ করেন।

সংবাদ প্রকাশঃ  ১৮-১১-২০২১ইং । (সংবাদটি গুরুত্বপূর্ণ মনে হলে দয়া করে ফেসবুকে লাইক বা শেয়ার করুন) (If you think the news is important, please share it on Facebook or the like  See More =আরো বিস্তারিত জানতে ছবিতে/লিংকে ক্লিক করুন=  

(সংবাদটি গুরুত্বপূর্ণ মনে হলে দয়া করে ফেসবুকে লাইক বা শেয়ার করুন)
(If you think the news is important, please like or share it on Facebook)
আরো পড়ুনঃ