না’গঞ্জে মসজিদে বিস্ফোরণ নিহত বেড়ে ১৬ : ২৩ জনের অবস্থাও আশঙ্কাজনক

সিটিভি নিউজের ইউটিউব চ্যানেলটি সাবস্ক্রাইব করুন

সিটিভি নিউজ, এম আর কামাল, নারায়ণগঞ্জ থেকে জানান : নারায়ণগঞ্জ শহরের পশ্চিম তল্লা এলাকার বাইতুস সালাত জামে মসজিদে বিস্ফোরণের ঘটনায় আরও দুইজনের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে নিহতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ালো ১৬ জনে। বাকীদের অবস্থাও আশঙ্কাজনক। ফলে নিহতের সংখ্যা বাড়তে পারে।
শনিবার (৫ সেপ্টেম্বর) দুপুরে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের সমন্বয়ক ডা. সামন্ত লাল সেন ১৬ জনের মৃত্যুর বিষয়টি সাংবাদিকদের নিশ্চিত করেছেন।
মৃত ব্যক্তিরা হলেন, সাব্বির (২২), দেলোয়ার হোসেন (৪৫), জুয়েল (৭), জামাল (৪০), জুবায়ের (১৪), রিফাত (১৮), হুমায়ুন কবির (৪৩), কাঞ্চন (৩৭), নয়ন (২৭), হুমায়ুন কবির (৭০), মোস্তফা কামাল (৩৫), ইব্রাহিম (৪৩), রিফাত (১৮), জুনায়েদ (১৭), কুদ্দুস বেপারি (৭২) ও রাসেল (৩৪)।
ডা. সামন্ত লাল সেন বলেন, নারায়ণগঞ্জের বিস্ফোরণের ঘটনায় এ পর্যন্ত ১৬ জন মারা গেছেন। আমাদের কাছে মোট ৩৭ জন রোগী এসেছিলেন। বাকি যারা ভর্তি আছেন তাদের অবস্থাও আশঙ্কাজনক। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ফোনে ঘটনার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছেন এবং চিকিৎসার জন্য সব ধরনের ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন।
আহতদের মধ্যে কয়েকজনকে নিবিড় পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রে (আইসিইউ) নেয়া হয়েছে। আহতদের অধিকাংশের শরীরে ৬০ থেকে ৯৫ শতাংশ পর্যন্ত দগ্ধ হয়েছে বলে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন।
এর আগে সকাল ১১টা পর্যন্ত যারা মারা গেছেন তারা হলেন মুয়াজ্জিন দেলোয়ার হোসেন (৪৮), রিফাত (১৮), মোস্তফা কামাল (৩৪), জুনায়েদ (১৮), সাব্বির (২১), কুদ্দুস ব্যাপারী (৭২), হুমায়ুন কবির (৭০), ইব্রাহিম (৪৩), জুনায়েদ (১৭), জামাল (৪০), জুবায়ের (৭) ও রাসেল (৩৪)।
নিহতদের মধ্যে সাব্বির সরকারি তোলারাম কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র জুবায়ের ও তার ভাই সাব্বির নারায়ণগঞ্জ কলেজের ছাত্র।
নুর উদ্দিন বলেন, বড় ছেলে মো. সাব্বির নারায়ণঞ্জের একটি কলেজে অনার্স তৃতীয় বর্ষে লেখাপড়া করতেন। আর তার ছোট ছেলে নারায়ণগঞ্জের তোলারাম কলেজের উচ্চ মাধ্যমিকের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। দুর্ঘটনার সময় বড় দুই ভাইয়ের সঙ্গে তার ছোট ছেলে ইয়াসিনও (১২) ছিল। তারা তিনজনই এক সঙ্গে নামাজ পড়তে ওই মসজিদে গিয়েছিলেন। তবে ইয়াসিন পেছনের সারিতে দাঁড়ানোর কারণে বিস্ফোরণের সঙ্গে সঙ্গে দৌড়ে মসজিদ থেকে বেরিয়ে যাওয়ায় সে সুস্থ আছে।
কান্না করতে করতে নুর উদ্দিন বলেন, ছোট ছেলে যুবায়েরের মৃত্যুর গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে। তবে আমাদের এখনো কেউ কিছু বলেনি। আমরাও জানার চেষ্টা করছি। তবে হাসপাতালের ভেতরে ঢুকতে পারি না।
শিশু জুবায়ের মা গার্মেন্টকর্মী রাহিমা বেগম বলেন, জুবায়ের বাবা জুলহাশ ও আমি ফতুল্লার কায়েমপুরে পৃথক দুটি গার্মেন্টে কাজ করি। এক বছর বয়সে জুবায়েরকে গ্রামের বাড়ি বরিশালের গন্ডাদুলা গ্রামে তার দাদীর কাছে রেখে ফতুল্লার পশ্চিম তল্লা এলাকায় ভাড়া বাসায় উঠি। এরপর স্বামী-স্ত্রী দুজনেই কাজে যোগ দেই।
গ্রাম থেকে আমার শাশুড়ি ফোন করে জানায় জুবায়ের স্কুলে যেতে চায়, পড়তে চায়। এরপর জুবায়ের বাবাকে বললাম ছেলেতো বড় হয়েছে। স্কুলে পড়ার বয়স হইছে। জুবায়েররে লইয়া আও।
কোরবানীর ঈদের পর জুবায়েরকে নিয়ে আসি আমাদের কাছে। এরপর বাড়ির কাছে সবুজবাগ মডেল কিন্ডারগার্টেন স্কুলে ভর্তিও করেছি। স্কুল থেকে মাস্টাররা বললো করোনা গেলে স্কুলে দিয়ে যাবেন। এখনতো জুবায়ের আর কোন দিন স্কুলে যাবেনা।
তিনি বলেন, জুবায়ের তার বাবার সঙ্গে প্রতি ওয়াক্তে নামাজ পড়তে যেতো। শুত্রবারও গিয়েছিল। তার বাবার অবস্থাও ভালো না। আমি এখন কী করমু।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার ফতুল্লার পশ্চিম তল্লার বাইতুস সালাত জামে মসজিদে বিস্ফোরণে হতাহতের ঘটনায় গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন। প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব ইহসানুল করিম বাসসকে জানান, প্রধানমন্ত্রী সার্বক্ষণিক বিস্ফোরণের খোঁজ-খবর নিচ্ছেন এবং দগ্ধদের সর্বোচ্চ চিকিৎসার নির্দেশ দিয়েছেন।
বিস্ফোরণের ঘটনায় পৃথক তিনটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স, তিতাস গ্যাস ও নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসন আলাদাভাবে এসবক কমিটি গঠন করে। তদন্ত কমিটিকে আগামী ৫ কার্য দিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
বিস্ফোরণের ঘটনায় গভীর তদন্ত চেয়েছেন স্থানীয় এমপি শামীম ওসমান। তিনি বলেছেন, এটা দুর্ঘটনা বা নাশকতা আমি কোনটিই বলবো না। কিন্তু আমি নাশকতার বিষয়টিকেও ফেলে দিচ্ছি না। আমার আশংকা করছি এটা।
শুক্রবার ৪ সেপ্টেম্বর রাতে বিস্ফোরণের পরদিন ৫ সেপ্টেম্বর শনিবার দুপুর দেড়টায় শামীম ওসমান মসজিদ পরিদর্শন আসেন। তিনি মসজিদের ভেতরে ঘুরে দেখেন।
পরে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ঘটনাটিকে তুচ্ছভাবে দেখার সুযোগ নাই। এটা ছোট কোন জিনিস না। শুধু গ্যাসের কারণেই এত বড় বিস্ফোরণ ঘটেছে এটাকেই প্রাধান্য দিয়েই শেষ করা যাবে না। কারণ এর আগেও আমাদের উপরেও ১৬ জুন বোমা হামলার ঘটনা ঘটেছে। সে কারণেই আমি বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে তদন্তের জন্য সংশ্লিষ্টদের আহবান জানাচ্ছি।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, শুক্রবার পৌনে ৯টায় বিকট শব্দে বিস্ফোরণ ঘটে। মুহূর্তেই মসজিদের ভেতরে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। ওই সময়ে মসজিদে থাকা মুসল্লীদের গায়ে আগুনের ফুলকি গিয়ে পড়লে একে একে দগ্ধ হতে থাকে। মসজিদের ভেতর থেকে আসতে থাকে মুসল্লীদের আত্মচিৎকার। পরে আশেপাশের লোকজন দিয়ে তাদের উদ্ধার করে। তাদের অনেকের শরীরের কাপড় ছিল না।
দুর্ঘটনার পর সেখানে দেখা গেছে, মসজিদের ভেতরের কয়েকটি স্থানেই প্রচুর পানি জমে ছিল। এসব পানিতে রক্ত ছিল। লাল হয়ে ছিল পানি।
প্রত্যক্ষদর্শীরা আরো জানান, বিকট শব্দে বিস্ফোরণের পর বিদ্যুৎ চলে যায়। তখন মসজিদ থেকে একে একে মুসল্লীরা খালি গায়ে দগ্ধ হয়ে বের হতে থাকে। বাঁচাও বাঁচাও চিৎকার করে একে একে বেরিয়ে আসতে থাকে। তাদের চিৎকারে সেখানে হৃদয়বিদারক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। একে একে মুসল্লীদের রিকশায় করে দ্রুত হাসপাতালে নেওয়া হয়।
স্থানীয়রা জানান, মুহূর্তের মধ্যে মসজিদের এসিও বিস্ফোরণ ঘটে। স্থানীয়রা জানান, পৌনে ৯টায় বিকট শব্দে বিস্ফোরণ ঘটে। মুহূর্তের মধ্যে মসজিদের ভেতরে থাকা ৩০ থেকে ৪০ জনের মধ্যে আতংক ছড়িয়ে পড়ে। হুড়োহুড়ি করে বের হয় লোকজন। তাদের অনেকেই দগ্ধ ও আহত ছিল।
মসজিদের ভেতরে এক ধংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। মসজিদের জানালার গ্লাসগুলোর সবগুলো ভাঙ্গা ছিল। ভেতরে কয়েকটি চেয়ার ছিল ভাঙাচোরা। ফ্যানগুলোও বাকা হয়ে যায়। ভেতরে থাকা দেড় ও ২ টনের ৬টি এসির সবগুলো বিস্ফোরণ ঘটে ভেতরের যন্ত্রাংশ বেরিয়ে গেছে। মসজিদের ভেতরে ফ্লোরের কিছু স্থানে রক্তের পানি দেখা গেছে।
নারায়ণগঞ্জ ১০০ শয্যা হাসপাতালের জরুরী বিভাগের ডাক্তার নাজমুল হোসেন জানান, রাত ৯টা হতে একের পর এক রোগী আসছিল। তাদের সকলের নাম লিপিবদ্ধ করা হয়নি। যেসব রোগী এসেছে তাদের ৭০ থেকে ৭৫ ভাগ দগ্ধ হয়েছে। তাদের দ্রুত প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে ঢাকা পাঠানো হয়েছে।
রাতে বার্ন ইউনিটে হাসপাতালের ইমাম মালেক আনসারি, মুয়াজ্জিন দেলোয়ার হোসেন, সাংবাদিক নাদিম সহ ৩৭ জনকে সেখানে ভর্তি করা হয়ছিল।
তাদের কয়েকজনের নাম পাওয়া গেছে। তারা হলো মো. আজিজ, মিজান, হুমায়ুন কবির, জুলহাস, ইব্রাহিম, ইমাম হোসেন, আমজাদ হোসেন, মোস্তফা কামাল, ছাত্তার, আব্দুল মালেক, কাঞ্চন হাওলাদার, জোনায়েদ, ফরিদ, শেখ ফরিদ, শোমিক, রিফাত, মহিউদ্দিন, রাসেল, রাশেদ, নয়ন, আব্দুল বাশার মোল্লা, বাহাউদ্দিন, শামীম হাসান, জোবায়ের, জয়নাল, মোহাম্মদ আলী, ছাব্বির, মামুন, কুদ্দুস বেপারী, লিয়াকত, জামাল, ইনু, শাহেদ প্রমুখ। রাত ১টায় জুয়েল নামের ৭ বছরের এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে।
বাইতুস সালাত জামে মসজিদ কমিটির সভাপতি গফুর মিয়া জানান, রাত পৌনে ৯টায় এশার নামাজ শেষ হওয়ার পরেই সুন্নত ও মোনাজাতের সময়ে বিকট শব্দ ঘটে। মসজিদের ভিতরের জানালাগুলো ভেঙ্গে চুরমার হয়ে ভিতরে বাহিরে ধোঁয়ায় ডেকে যায়। তখন আমি বাহিরে ছিলাম আর আমাদের মসজিদ কমিটির সেক্রেটারী হান্নান মিয়া মসজিদের ভিতর নামাজে ছিলো। তখন দ্রুত আমিসহ এলাকাবাসী এগিয়ে এসে প্রায় ৪০ জনকে দগ্ধ অবস্থায় উদ্ধার করে শহরের ভিক্টোরিয়া জেনারেল হাসপাতালে প্রেরন করি। সেখান থেকে অনেককেই আশঙ্কাজনক অবস্থায় ঢাকা মেডিকেলে প্রেরন করেছে জরুরী বিভাগের চিকিৎসক।
ফায়ার সার্ভিসের নারায়ণগঞ্জের উপ সহকারী পরিচালক আবদুল্লাহ আরেফিন জানান, ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে দেখা গেছে মসজিদের তল দিয়ে গ্যাসের একটি পাইপ রয়েছে। ওই পাইপের লিকেজ দিয়ে মসজিদের ভেতরে গ্যাস জমে যায়। এর মধ্যে এসি চলার কারণে মসজিদের ভেতরে সবগুলো জানালা ও দরজা টাইট করে বন্ধ ছিল। ফলে নির্গত গ্যাস বের হতে পারেনি। বিস্ফোরণের আগে কেউ হয়তো বাতি বা বিদ্যুতের কিছু জালানোর সময়ে স্পার্ক করে। সেই স্পার্ক থেকেই বিস্ফোরণ ঘটে। সঙ্গে সঙ্গে সেটার কারণে এসি ও বাইরের ট্রান্সফরমারেও আগুন ধরতে পারে।
এলাকাবাসীর অভিযোগ, মসজিদ পরিচালনা কমিটির সেক্রেটারী হান্নান মিয়া নিজেও এ দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন। তিনি কয়েকদিন আগেও তিতাস গ্যাসকে এ লাইন সংস্কারের কথা বলেছিলেন। কিন্তু তিতাস তখন ৫০ হাজার টাকা দাবী করেন। টাকা না দেওয়ার কারণে লাইন মেরামত বা সংস্কার করেনি। ফলে লিকেজ হয়ে অন্য দিনের মতই গ্যাস জমে যায় মসজিদে। আর গরমের কারণে এসি চালানোর ফলে বাতাস বের হতে না পারায় গ্যাস জমে যায়। আর সেই থেকেই মূলত দুর্ঘটনা ঘটেছে।

সংবাদ প্রকাশঃ  ০৫২০২০ইং (সংবাদটি গুরুত্বপূর্ণ মনে হলে দয়া করে ফেসবুকে লাইক বা শেয়ার করুন) (If you think the news is important, please share it on Facebook or the like সিটিভি নিউজ@,CTVNEWS24   এখানে ক্লিক করে সিটিভি নিউজের সকল সংবাদ পেতে আমাদের পেইজে লাইক দিয়ে আমাদের সাথে থাকুনসিটিভি নিউজ।। See More =আরো বিস্তারিত জানতে লিংকে ক্লিক করুন=

Print Friendly, PDF & Email