সিটিভি নিউজ।। এবিএম আতিকুর রহমান বাশার, দেবীদ্বার (কুমিল্লা) প্রতিনিধি/================
কোটা সংস্কার আন্দোলনে নিহত ১০ বছর বয়সী শিশু হোসাইনের বাড়িতে এখনও চলছে শোকের মাতম। আন্দোলন চলাকালে ২০ জুলাই দুপুরে রাজধানীর চিটাগাং রোড এলাকায় আন্দোলনকারীদের সাথে আইনশৃংখলা বাহিনীর গোলাগুলি ও সংঘর্ষ চলাকালে হোসাইনের বুকে ও তলপেটে ২টি গুলিবিদ্ধ হয়ে সে মারা যায়। ২২ জুলাই সোমবার রাত ২টায় তার মামারবাড়ি কুমিল্লার দেবীদ্বার উপজেলার রাজামেহার ইউনিয়নের বেতোরা গ্রামে দাফন সম্পন্ন হয়।
শনিবার (২৭ জুলাই) বিকেলে সরেজমিনে বেতোরা গ্রামে যেয়ে দেখা যায় শোকর্ত মানুষের ঢল। স্বজন প্রতিবেশীরা নিহত হোসাইনের বাবা-মা’কে শান্তনা দেয়ার চেষ্টা করেন। তারা কোন শান্তনাই মানছেনা। হোসাইনের বাবা’-মা’ মোবাইল ফোনে সন্তানের ছবি দেখে সন্তানের শোকে বার বার মুর্ছা যাচ্ছেন। মা’ চিৎকার করে বলছেন,- ‘আন্দোলন আমার বুকের ধন কেড়ে নিল’।
নিহত হোসাইনের মা’ মালেকা বেগমের সাথে কথা বলে জানা যায়, ঘটনার দিন পুলিশ ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে ধাওয়া পাল্টাধাওয়া চলছিল। মুহুর্মুহু গুলির আওয়াজ ও ককটেল বিস্ফোরণ, টিয়ারসেলে পুরো এলাকা প্রকম্পিত ও অন্ধকার হয়ে পড়ে। আতঙ্কিত বাসা- বাড়ির লোকজন দরজা- জানালা বন্ধ করে কেউ ঘরে, কেউবা ছাদের উপর থেকে গোলাগুলির দৃশ্য দেখছেন। মানুষের শূরগোল আর আর্তনাদ চলছিল। আমার মানিক ধনকে বলি বাবা ঘর থেকে বের হয়োনা। দুপুরের দিকে খাবার খাইয়ে দেই। সে আমাকে বলে,- মা’ খেলনার গোলাগোলি হচ্ছে, পটকা ফুটাচ্ছে, ফাঁকা গুলি ছুড়ছে, কিছু হবেনা, ভয় পেয়োনা। কিছুক্ষন পর আমার ছেলেকে আর খুঁজে পাচ্ছিলাম না। তখন তার বাবা বাসার বাহিরে ছিল। পরে বুঝলাম, সে এ অবস্থার মধ্যদিয়ে পপকর্ন, আইসক্রিম ও চকলেট ফেরি করে বিক্রি করতে বেড়িয়ে গেছে।
বিকেল গড়িয়ে আসলেও বাসায় ফেরেনি হোসাইন মিয়া। তার বাবা বাসায় ফিরে আসে। বিকেল সাড়ে পাঁচটা অব্দি বাসায় না ফেরায় সন্তানের খোঁজে তার বাবা মানিক মিয়া বের হন। সংঘর্ষের কারণে প্রায় ২ ঘন্টা পর্যন্ত উল্টো পথে ঘুরে বাসায় এসে দেখেন, তখনো তাঁর ছেলে বাসায় ফেরেনি। তখন বাসায় ছোট্ট দুই মেয়ে মাহিনুর আক্তার (৮) ও শাহিনুর আক্তার (৬)কে ঘরে তালাবন্দী করে মানিক মিয়া ও স্ত্রী মালেকা বেগমকে সঙ্গে নিয়ে সন্তানের খোঁজে বের হন। চিটাগাং রোডসহ আশপাশের এলাকা তন্ন তন্ন করে খুঁজেও হদিস মেলেনি হোসাইনের।
রাত নয়টার দিকে কেউ একজন এসে মুঠোফোনে হোসাইনের ছবি দেখান। মানিক ও মালেকা সন্তানের আহত অবস্থার ছবি দেখে চিনতে পারেন। তাঁরা জানতে পারেন, হোসাইনকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আর দেরি না করে স্বামী-স্ত্রী একটি পিকআপে করে যাত্রাবাড়ী পর্যন্ত যান। সেখান গিয়ে আরও বিপদ। সড়কে কোনো গাড়ি নেই। কিছু সময় হেঁটে, কিছু সময় জিরিয়ে নিয়ে এগিয়ে চলেন। পথে পথে সংঘর্ষ। পরে এক রিকশাওয়ালাকে হাতে-পায়ে ধরে রাত সাড়ে ১২টায় ঢাকা মেডিকেলে পৌঁছান। ঢাকা মেডিকেলের সব জায়গা খুঁজে হোসাইনকে পেলেন না। চিকিৎসকদের কাছে গেলে তাঁরা বলেন, চিটাগাং রোড এলাকা থেকে গুলিবিদ্ধ অনেককেই আনা হয়েছে। আহত সবার চিকিৎসা চলছে। চিকিৎসকদের কাছে অনেক অনুরোধ করেও তাদের সন্তানকে দেখার সুযোগ পাননি। চিকিৎসকের কথায় হাসপাতালের বারান্দায় বসে অপেক্ষা করছিলেন, চিকিৎসা শেষ হলে সন্তানকে দেখতে যাবেন। রাত ২টায় একজন নার্স এসে তাদের জিজ্ঞাসা করেন, তাঁরা কেন এখানে বসে আছেন? পরে নিজের সন্তানের কথা বলেন। তখন ওই নার্স বলেন, ছেলের নামকি হোসাইন ? তারা বলেন, হ্যা। তখন তাঁদের লাশঘরের কাছে নিয়ে যান। অনেকগুলো মরদেহের সঙ্গে ছোট্ট হোসাইনের মরদেহ দেখে বাবা মানিক মিয়া জ্ঞান হারান। মা মালেকা বেগমের চিৎকারে ভারী হয়ে ওঠে ঢাকা মেডিকেলের পরিবেশ।
যে বয়সে লেখাপড়া আর খেলাধুলায় ব্যাস্ত থাকার কথা, সে বয়সে বাবার সাথে পরিবারের অভাব ঘুচাতে ১০ বছর বয়সী হোসাইন মিয়া ফুটপাতে, রাস্তায়- পার্কে- বাস ষ্ট্যাশনের ঘুরে ঘুরে পপকর্ন, আইসক্রিম ও চকলেট ফেরি করে বিক্রি করত।
গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যাওয়ার পর হোসাইনের মরদেহ ২২ জুলাই রাত দুইটার দিকে নানাবাড়ি কুমিল্লার দেবীদ্বারের রাজামেহার ইউনিয়নের বেতরা গ্রামে দাফন করা হয়েছে। নিহত হোসাইনের মামা মোস্তফা কামাল এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, ‘হোসাইনের পরিবার ঢাকায় থাকলেও তারার তেমন কিছু নাই। বাপ-ছেলে ফেরি করে যা পায়, তা দিয়ে তাদের সংসার চলত।
নিহত হোসাইনের বাবা মানিক মিয়া বলেন, তাঁর বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলার বরিশল গ্রামে। সেখানে তাঁর স্বজন বলতে কেউ নেই। বিয়ের পর থেকে তিনি কুমিল্লার দেবীদ্বার উপজেলার বেতোরা গ্রামে শ্বশুরবাড়িতে থাকতেন। বছর পাঁচেক আগে ঢাকায় যান। চিটাগাং রোড মুক্তিনগর এলাকায় একটি ভাড়া বাসায় থাকেন। ঢাকায় বাবা- ছেলে মিলে সারা দিন ফেরি করেন। চিপস, চকলেট, পাপন, আইসক্রিম বিক্রি করেন। তাদের সংসারে ২ কণ্যা সন্তান ও ১ পুত্র সন্তানের মধ্যে নিহত হোসাইন ছিল তাদের বড় ছেলে। সেও ফেরি করত।
মানিক মিয়া আরো বলেন, আমার ছেলে শনিবার বিকেলে মারা গেছে। তার বুকে গুলিবিদ্ধ হয়ে পেছন দিক দিয়ে বেড়িয়ে গেছে। আর একটি গুলি তলপেটে বিদ্ধ হয়েছে। তার লাশ আনতে গিয়ে আমাদের অনেক বিপদে পড়তে হয়েছে। এই অফিসে যাও, সেই অফিসে যাও। শাহবাগ থানায় গিয়ে জিডি করো। কত স্বাক্ষর দিতে হয়েছে, কত যে হয়রানীর শিকার হয়েছি। তারপর সোমবার ১০ হাজার টাকায় এ্যাম্বুলেন্স ভাড়ায় ছেলের লাশ আনতে পেরেছি। এই লাশ আনতে গিয়েও বিপদের শেষ ছিলনা।
দেবীদ্বার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নিগার সুলতানা শনিবার বিকেল ৬টায় জানান, তিনি গতকাল শুক্রবার নিহত শিশুর বাড়িতে গিয়ে শোকার্ত পরিবারকে শান্তনা দিয়েছেন। এবং নগদ ২০ হাজার টাকা দিয়ে ভবিষ্যতে কোন ধরনের সমস্যায় পড়লে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে আশ^াস প্রদান করেছি।
ছবির ক্যাপশনঃ নিহত শিশু হোসাইনের ফাইল ছবি। নিহতের বাড়িতে বাবা মানিক মিয়া ও মা’ মালেকা বেগম সন্তান হারিয়ে আর্তনাদ করছেন। সংবাদ প্রকাশঃ ২৮-৭-২০২৪ ইং সিটিভি নিউজ এর (সংবাদটি গুরুত্বপূর্ণ মনে হলে দয়া করে ফেসবুকে লাইক বা শেয়ার করুন) (If you think the news is important, please share it on Facebook or the like> See More =আরো বিস্তারিত জানতে কমেন্টসে লিংকে ছবিতে ক্লিক করুন= =আরো বিস্তারিত জানতে কমেন্টসে লিংকে ক্লিক করুন=