সিটিভি নিউজ।। এইচ এম গোলাম কিবরিয়া রাকিব মুক্তকলাম লেখক ও কলামিস্ট =============
মহররম হিজরি বছরের প্রথম মাস। পবিত্র কোরআনে এ মাসের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। সুরা তওবার ৩৬নং আয়াতে বর্ণিত যে মাসগুলোয় যুদ্ধবিগ্রহ হারাম করা হয়েছে তার মধ্যে মহররম অন্যতম। অনেক কারণে এ মাসটি মুসলিম উম্মাহর কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। স্বয়ং রসুল (সা.) নিজে এ মাসকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে বর্ণনা করেছেন এবং তিনি ধরাবাসীর প্রতি তার দায়িত্ব অর্থাৎ মানুষকে শান্তির ধর্ম ইসলামের পথে আহ্বান করার কাজ শুরু করেছিলেন মহররম মাসে।
মহররম শব্দের অর্থ অলঙ্ঘনীয় পবিত্র। ইসলামের ইতিহাসে মহররম মাসটি অত্যন্ত ফজিলতময় ও মর্যাদাপূর্ণ। এ মাসেই বহু নবী-রসুল ঈমানের কঠিন পরীক্ষার মাধ্যমে মুক্তি ও নিষ্কৃতি পেয়েছিলেন। মহররম মাস মুসলিম উম্মাহর জন্য অত্যন্ত সম্মানিত ও মর্যাদার মাস। অসংখ্য তথ্যবহুল ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী এ পবিত্র মাস এবং এ কারণে এ মাসের গুরুত্ব ও তাৎপর্য অত্যধিক। প্রাচীনকাল থেকেই আশুরার ঐতিহ্যের স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। হজরত হুসাইন (রা.)-এর মর্মান্তিক শাহাদতের ঘটনার অনেক আগ থেকেই আশুরা অনেক তাৎপর্যপূর্ণ ও রহস্যঘেরা দিন। তবে এ কথা সত্য ১০ মহররম কারবালা প্রান্তরে হজরত ইমাম হোসেন (রা.) তার দলবলসহ শহীদ হওয়ার ঘটনা এ দিনের গুরুত্ব ও তাৎপর্যকে বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে। এ কারণে মুসলমানরা দিনটিকে ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যের মধ্য দিয়ে পালন করে থাকেন এবং প্রত্যেক মুসলমানের কাছে এর গুরুত্ব তাৎপর্যপূর্ণ।
আশুরার ইতিহাসে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ও ঐতিহাসিক ঘটনা হচ্ছে- হজরত মুসা (আ.)-এর ফিরাউনের অত্যাচার থেকে নিষ্কৃতি লাভ। এই দিনে মহান আল্লাহতায়ালা চিরকালের জন্য লোহিত সাগরে ডুবিয়ে শিক্ষা দিয়েছিলেন ভ্রান্ত খোদার দাবিদার ফিরাউন ও তার বিশাল বাহিনী। অনেকে মনে করেন, ফিরাউন নীলনদে ডুবেছিল। ঐতিহাসিকদের বর্ণনা অনুযায়ী এই ধারণা ভুল। বরং তাকে লোহিত সাগরে ডুবিয়ে বিশ্ববাসীকে শিক্ষা দেওয়া হয়।
হিজরি ৬০ সালে পিতার মৃত্যুর পর ইয়াজিদ বিন মুয়াবিয়া নিজেকে মুসলিম বিশ্বের খলিফা হিসেবে ঘোষণা করে। অথচ ইয়াজিদ প্রকৃত মুসলমান ছিল না, বরং সে মোনাফেক ছিল। সে এমনই পথভ্রষ্ট ছিল যে, ইসলামে চিরতরে নিষিদ্ধ মধ্যপানকে সে বৈধ ঘোষণা করেছিল। অধিকন্তু সে একই সঙ্গে দুই সহোদরকে বিবাহ করাকেও বৈধ ঘোষণা করেছিল। শাসক হিসেবে সে ছিল স্বৈরাচারী ও অত্যাচারী। এসব কারণে হজরত হোসাইন (রা.) শাসক হিসেবে ইয়াজিদকে মান্য করতে অস্বীকৃতি জানান এবং কুফাবাসীর আমন্ত্রণ ও ইসলামের সংস্কারের লক্ষ্যে মদিনা ছেড়ে মক্কা চলে আসেন। এখানে উল্লেখ্য যে, উমাইয়াদের শাসনামলে ইসলাম তার মূল গতিপথ হারিয়ে ফেলেছিল। হজরত ইমাম হোসাইন (রা.) মক্কা থেকে কুফার উদ্দেশে যাত্রা করেন। শেষ পর্যন্ত তিনি কারবালার উদ্দেশে যাত্রা করেন।
এ সময় উমর ইবনে সাদ আবি ওক্কাসের নেতৃত্বে চার হাজার সৈন্য কারবালায় প্রবেশ করে। কয়েক ঘণ্টা পর ইসলামের জঘন্য দুশমন শিমার ইবনে জিলজুশান মুরাদির নেতৃত্বে আরো বহু নতুন সৈন্য এসে আবি ওক্কাসের বাহিনীর সঙ্গে যোগ হয়। অবশেষে বেজে ওঠে যুদ্ধের দামামা। এ যুদ্ধ সত্য এবং মিথ্যার দ্বন্দ্বের অবসান ঘটানোর সংগ্রাম। কারবালায় দুই পক্ষ মুখোমুখি অবস্থান নেয়। নানা নাটকীয় ঘটনার মধ্য দিয়ে যুদ্ধ শুরু হয়। এই অসম যুদ্ধে ইমাম হোসাইন (রা.) এবং তার ৭২ জন সঙ্গী শাহাদতবরণ করেন। শিমার ইবনে জিলজুশান মুরাদি নিজে ইমাম হোসাইনের কণ্ঠদেশে ছুরি চালিয়ে তাকে হত্যা করে। আর সে বেদনাহত দিনটা ছিল হিজরি ৬১ সালের ১০ মহররম।
ইসলামের ইতিহাসে ফজিলতময় আশুরা বিভিন্ন ঘটনাপুঞ্জে সমৃদ্ধ থাকলেও সর্বশেষ সংঘটিত কারবালা প্রান্তরে হজরত ইমাম হোসাইন (রা.)-এর শাহাদতই এ দিবসের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। আশুরা দিবসে হজরত ইমাম হোসাইন (রা.) কারবালায় অন্যায়, অবিচার, স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে ন্যায় ও সত্যের জন্য রণাঙ্গনে অকুতোভয় লড়াই করে শাহাদতবরণ করেছিলেন; কিন্তু তিনি অসত্য, অধর্ম ও অন্যায়ের কাছে মাথা নত করেননি। ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য জীবন বাজি রেখে সপরিবারে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন। ইসলামের সুমহান আদর্শকে সমুন্নত রাখার জন্য তার এ বিশাল আত্মত্যাগ ইতিহাসে সমুজ্জ্বল হয়ে আছে। সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার মুসলিম উম্মাহর জন্য এক উজ্জ্বল ও অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত।
কারবালার ঘটনা থেকে মানবগোষ্ঠীর জন্য যেসব শিক্ষা রয়েছে, তন্মধ্যে প্রধান হচ্ছে হজরত ইমাম হোসাইন (রা.) নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন, তবু ক্ষমতার লোভে ন্যায়নীতির প্রশ্নে আপস করেননি। খেলাফতকে রাজতন্ত্র ও স্বৈরতন্ত্রে রূপান্তরে ইয়াজিদের বলপ্রয়োগে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলের চক্রান্তের প্রতি আনুগত্য স্বীকার না করে তিনি প্রত্যক্ষ সংগ্রামে লিপ্ত হন। বিশ্ববাসীর কাছে তিনি অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও ন্যায়ের পক্ষে প্রতিরোধ সংগ্রামের এক জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন। কারবালা প্রান্তরে সত্য ও ন্যায়কে চির উন্নত এবং সুপ্রতিষ্ঠিত করার জন্য তিনি সর্বোচ্চ ত্যাগের অতুলনীয় আদর্শ স্থাপন করেছেন। ঐতিহাসিক ১০ মহররম চিরকাল বিশ্বের নির্যাতিত, অবহেলিত এবং বঞ্চিত মানুষের প্রতি অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার দিকনির্দেশনা ও অনুপ্রেরণা জোগাবে। এভাবে পৃথিবীতে সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার ইতিহাসে আশুরার দিবসে হজরত ইমাম হোসাইন (রা.)-এর শাহাদত এক অনন্য, অনুসরণীয় ও অনুকরণীয় অধ্যায়ের সৃষ্টি করেছে। ইসলামের কালজয়ী আদর্শকে সমুন্নত রাখার জন্যই কারবালায় নবীবংশের আত্মত্যাগ হয়েছিল।
মূলত আশুরার দিনে মুসলমানরা ন্যায় প্রতিষ্ঠাকল্পে আত্মত্যাগের এক অনুপম আদর্শ শিক্ষা গ্রহণ করেন। ব্যক্তিস্বার্থ, ক্ষমতালিপ্সা ও মসনদের লোভ-মোহের ঊর্ধ্বে উঠে হজরত ইমাম হোসাইন (রা.) বুকের তাজা রক্ত প্রবাহিত করে ইসলামের শাশ্বত নীতি ও আদর্শকে সমুন্নত করলেন। কারবালার রক্তাক্ত সিঁড়ি বেয়েই ইসলামের পুনরুজ্জীবন ঘটে। কারবালা ট্র্যাজেডির বদৌলতেই ইসলাম স্বমহিমায় পুনরুজ্জীবিত হয়েছে। সত্যের জন্য শাহাদতবরণের এ অনন্য দৃষ্টান্ত ও ত্যাগ-তিতিক্ষার মাহাত্ম্য তুলে ধরার মধ্যেই নিহিত রয়েছে ১০ মহররমের ঐতিহাসিক তাৎপর্য। আশুরা দিবসে কারবালার শিক্ষণীয় এবং করণীয় হলো, অন্যায় ও অসত্যের বিরুদ্ধে সংগ্রামীদের সামনে প্রতিপক্ষের পক্ষ থেকে কোনো সময় অর্থ, বিত্ত ও সম্মানের লোভনীয় প্রস্তাব এলেও ঘৃণাভরে তা প্রত্যাখ্যান করে আপসহীন মনোভাবের মাধ্যমে ত্যাগের চরম পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করতে হবে। কারবালার শোকাবহ ঘটনার স্মৃতিতে ভাস্বর আশুরার শাশ্বত বাণী তাই অন্যায় প্রতিরোধ ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হতে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করে এবং সত্য ও ন্যায়ের পথে চলার প্রেরণা জোগায়।
আশুরা এ মহান শিক্ষা দিয়েছে যে, সত্য কখনো অবনত শির হতে জানে না। বস্তুত কারবালা ছিল অসত্যের বিরুদ্ধে সত্যের সংগ্রাম, রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে সাধারণতন্ত্রের লড়াই। ইসলামি আদর্শকে সমুন্নত রাখার প্রত্যয়ে জীবন বিসর্জন দিয়েছিলেন হজরত ইমাম হোসাইন (রা.); কিন্তু স্বৈরতন্ত্রের সঙ্গে আপস করেননি। জীবনের চেয়ে সত্যের শ্রেষ্ঠত্ব রক্ষার জন্য নবী-দৌহিত্রের অভূতপূর্ব আত্মত্যাগ জগতের ইতিহাসে অত্যন্ত বিরল ঘটনা। কারবালার শোকাবহ ঘটনায় চিরন্তন সত্যের মহাবিজয় হয়েছিল এবং বাতিলের পরাজয় ঘটেছিল। সুতরাং আশুরার এ মহিমান্বিত দিনে শুধু শোক বা মাতম নয়, প্রতিবাদের সংগ্রামী চেতনা নিয়ে হোক চির সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য আজীবন লড়াই, প্রয়োজনে আত্মত্যাগ- এটাই মহররমের অন্তর্নিহিত শিক্ষা। কারবালার কথকতা শুধু শোকের কালো দিবসই নয়, এরমধ্যে সুপ্ত রয়েছে অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর জন্য কঠিন শপথ নেওয়ার এক সুদৃঢ় আকাক্সক্ষা।
ইহুদিরা আশুরা উপলক্ষে মহররম মাসের ১০ তারিখে রোজা রাখে। শিয়া সম্প্রদায় মর্সিয়া ও মাতমের মাধ্যমে এই দিনটি উদযাপন করে। আশুরা উপলক্ষে ৯ এবং ১০ মহররম তারিখে অথবা ১০ এবং ১১ মহররম তারিখ রোজা রাখা সুন্নত। আল্লাহর রসুল (সা.) এ তারিখে রোজা পালন করতেন। মুসলমানরা এদিন উত্তম আহারের চেষ্টা করে। মহররম বা আশুরা আজ গোটা মুসলিম বিশ্বে উদযাপিত হচ্ছে কিন্তু এর মূল শিক্ষা ও তাৎপর্যকে হারিয়ে আজ আমরা এ দিবসকে কোন কোন ক্ষেত্রে বিকৃতভাবে পালন করছি। রক্তের মাতম সৃষ্টি করছি, যা ইসলাম সমর্থন করে না। আজকে আমাদের অবস্থা হয়েছে সমাজবিজ্ঞানের জনক ইবনে খালদুন উচ্চারিত উক্তির মতো। তিনি বলেছেন, ‘বিশ্বের যে ঘটনা যত বেশি গুরুত্বপূর্ণ, যে ব্যক্তি যত বেশি মর্যাদাসম্পন্ন, সে ঘটনা ও ব্যক্তিত্ব তত বেশি কিংবদন্তি ও রূপকথার আবরণে আচ্ছাদিত এবং তত বেশি ভুল বোঝাবুঝিতে নিমজ্জিত।’
কারবালার ঘটনাই প্রকৃত জয়-পরাজয়ের দৃষ্টিভঙ্গির উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। ৬১ হিজরির ১০ মহররম কারবালায় ইমাম হোসাইন (রা.) মুসলিম উম্মাহের কাছে জয়-পরাজয়ের দৃষ্টিভঙ্গি ও তাৎপর্যসংবলিত উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত তুলে ধরেছেন। ইয়াজিদের সেনাবাহিনী যুদ্ধের ময়দানে জয়ী অথচ মুমিনের হৃদয় রাজ্যে হজরত হোসাইন (রা.) বিজয়ের মর্যাদায় ভূষিত ও অধিষ্ঠিত রয়েছেন। বিশেষ মর্যাদাপ্রাপ্ত এ মাস মুসলিম উম্মাহর ইবাদত-বন্দেগি, মহান আল্লাহর কাছে ক্ষমা লাভ এবং তার নৈকট্য অর্জনের জন্য স্মরণীয় ও বরণীয়।
-এইচ এম গোলাম কিবরিয়া রাকিব
প্রতিষ্ঠাতা-কুমিল্লা জিলা মাদরাসা। সংবাদ প্রকাশঃ ১৭-৭-২০২৪ ইং সিটিভি নিউজ এর (সংবাদটি গুরুত্বপূর্ণ মনে হলে দয়া করে ফেসবুকে লাইক বা শেয়ার করুন) (If you think the news is important, please share it on Facebook or the like> See More =আরো বিস্তারিত জানতে কমেন্টসে লিংকে ছবিতে ক্লিক করুন= =আরো বিস্তারিত জানতে কমেন্টসে লিংকে ক্লিক করুন=