হাজীগণের আকুতি “লাব্বায়েক আল্লাহুমা লাব্বায়েক” = গাজী মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম জাবির

সিটিভি নিউজ।।     হজ্ব শব্দের আভিধানিক অর্থ কাবা পরিদর্শন। সঙ্গতি সম্পন্ন প্রত্যেক মুসলমানের জন্য পৃথিবীর প্রথম উপাসনালয় কাবা শরীফ তাওয়াফ এবং মদিনা মনোয়ারা জিয়ারত অবশ্য কর্তব্য। হজের প্রথম তাৎপর্য হচ্ছে, এটি সমগ্র বিশ্ব মুসলিমের এমন এক মহা সমাবেশ যেখানে সমগ্র বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের, বিভিন্ন বর্ণের, ভাষা এবং আকার- আকৃতির মানুষ একই ধরনের পোশাকে সজ্জিত হয়ে একই কেন্দ্র বিন্দুতে এসে সমবেত হন। সকলের লক্ষ্য বিশ্ব মানবের প্রথম উপাসনা কেন্দ্র কাবার জেয়ারত, সবার মুখে একই ভাষার একটি মাত্র কথা ‘লাব্বায়েক  আল্লাহুম্মা ’ যার বাংলা অর্থ- হাজির হয়েছি ওগো আল্লাহ! হাজির হয়েছি। এসেছি, তোমার ডাকে সাড়া দেওয়ার জন্য এসেছি। আমার সকল কিছু তোমার কাছে সমর্পণ করতে এসেছি।
তাই বলতে হয়, হজের এ সফরের অন্য কোনো উদ্দেশ্য নয়, কোনো লক্ষ্য নয়, কোনো পার্থিব স্বার্থের আকর্ষণ নয়, শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি, আল্লাহর নির্দেশে সমগ্র বিশ্বমানবকে আপন করে পাওয়ার আকুতিটুকুই একান্ত কাম্য হয়ে দাঁড়ায়। আর এভাবেই হৃদয়ের গভীরে অঙ্কুরিত হয় বিশ্ব মুসলিমের ঐক্যের সেতুবন্ধন।

হজের এ মহাসমাবেশে সমগ্র বিশ্বমানব এমনই একটি কেন্দ্রবিন্দুতে এসে সমবেত হন, যা মানব জাতির প্রথম আবাসস্থল। ‘উম্মুল কোবা’ মক্কা নগরীতেই যে আদি মানব হযরত আদম (আঃ) প্রথম বসতি স্থাপন করেছিলেন এ তথ্য সন্দেহাতীত। সে আদি বসতির মধ্যেই এক আল্লাহর এবাদত আরাধনার লক্ষ্যে স্থাপিত প্রথম গৃহ পবিত্র বাইতুল্লাহ, এ তথ্যও পবিত্র কোরআনে পরিবেশিত হয়েছে। বর্ণিত আছে, হযরত আদম (আঃ) ‘উম্মুল কোবা’ পবিত্র মক্কায় স্থিত হওয়ার পর মোনাজাত বা প্রার্থনা করেছিলেন। ফেরেশতা-গণের উপাসনাস্থল বাইতুল মামুরের অনুরূপ একখানা উপাসনালয় পাওয়ার জন্য। আল্লাহপাক সে প্রার্থনা মঞ্জুর করেই ফেরেশতা জিব্রাঈলের মারফতে বাইতুল মামুরের সঠিক বরাবরেই মাটির উপর পবিত্র কাবাঘর নির্মাণের স্থান নির্দেশ করেন। এ ঘরের যে চৌহদ্দিটুকু ‘হেরেম’ বা পবিত্রতার সীমারেখায় চিহ্নিত সেটুকুও ফেরেশতার মাধ্যমেই আল্লাহপাক দেখিয়ে দিয়েছিলেন। ইতিহাসের সে প্রথম গৃহে  মানব সন্তানের জন্য সৃষ্ট প্রথম এবাদতগাহ বা উপাসনালয়ে আদি মানবের বাৎসরিক এ মহা সমাবেশে যে আবেগময় অনুভূতি সৃষ্টি করে সে অনুভূতি সমগ্র বিশ্ব মানব তথা আদি সন্তানের একই রক্তের উত্তরাধিকার এবং আত্মীয়তার অবিচ্ছেদ্য সেতু বন্ধনকেই নবায়িত করার অনুভূতি। পবিত্র কোরআনে এও বর্ণিত আছে, আমাদের আদি পিতা-মাতা প্রথম যেখানে সেজদা করেছিলেন সৃষ্টিকর্তা মহান প্রভুর উদ্দেশে। তার এবাদতের লক্ষ্যেই গড়ে তোলা হয়েছিল সে ঘরটি। সুতরাং সে ঘরের প্রতি একটা আবেগপূর্ণ আর্কষণ প্রতিটি মুমেন-মুসলমানের থাকা স্বাভাবিক। মোট কথা, প্রতিটি মানব    সন্তানের মন-মস্তিষ্কে সুপ্ত হয়ে থাকাটা স্বাভাবিক।

হজের বাৎসরিক সমাবেশ সে ঘরের জেয়ারত, সে ঘরের তাওয়াফ, স্মরনীয় সে ময়দানে গিয়ে অবস্থান যেখানে দীর্ঘ বিরহ- যাতনা ভোগ করার পর আমাদের প্রথম পিতা-মাতা এসে পুনঃমিলিত হয়েছিলেন, প্রাণভরে আল্লাহর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার সুযোগ লাভ করেছিলেন। মুক্তি এবং শাস্তিধারা প্রাপ্তির আশ্বাস প্রাপ্ত হয়ে পূর্ণ প্রশান্তিতে রাত যাপন করেছিলেন। কয়েক দিনের হজের সফর প্রতিটি হজযাত্রীকে নিয়ে যায় মানুষের এ জন্ম প্রবাহ শুরুর সেই আদি দিনগুলোতে। আজকের ভাষা, বর্ণ ও ভৌগোলিক সীমারেখা কণ্টকিত মানুষগুলো যখন কিছুদিনের জন্য সেই আদি মানবের সহজ-সরল পোশাক মাত্র দু টুকরো কাপড় পরিধান করে হজের অনুষ্ঠানগুলো পালন করেন, তখন তার মধ্যে যে উপলব্ধি জন্ম হয়, সেটা সকল মানুষের প্রতি বন্ধুপ্রতিম মমত্ববোধ ছাড়া আর কি হতে পারে।

ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের কাছে হজ তাৎপর্যপূর্ণ এবাদত। শারীরিক, মানসিক এবং আর্থিক দিক দিয়ে সামর্থ্যবান লোকজন হজ করতে যাবেন এটাই প্রত্যাশিত। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের সঙ্গে বাংলাদেশ থেকেও কয়েক হাজার ধর্মপ্রাণ মুসলমান মক্কা শরিফে হজ ও মদীনা শরিফ জেয়ারত করতে যান। হজের প্রধান শিক্ষাই হচ্ছে সমগ্র বিশ্ব মানবের মধ্যে অবিচ্ছেদ্য এক ভ্রাতৃত্ববোধ এবং সেতুবন্ধন তৈরি করা এবং ঐক্য গড়ে তোলার জন্য ব্রতী হওয়া।

হযরত নবী করীম (দঃ) সর্বশেষ হজের ভাষণের  মধ্যে এ শিক্ষাই সর্বাপেক্ষা গুরুত্বের সঙ্গে প্রদান করেছেন এবং উদাত্তকন্ঠে তিনি আহ্বান জানিয়ে বলেছিলেন- ‘লোক সকল, তোমাদের সকলের প্রভু এক, তোমাদের সকলের আদি পিতাও এক ব্যক্তি। সুতরাং কোনো আরব অনারবের ওপর, কোনো কৃষ্ণকায় শ্বেতাঙ্গের ওপর কিংবা কোনো কৃষ্ণকায়ের ওপর কোনো শ্বেতাঙ্গের জন্মগত কোনো প্রাধান্য নেই। সম্মান যোগ্য হবে সে ব্যক্তি যে একনিষ্ঠ খোদাভীরু। মনে রেখো, প্রত্যেক মুসলমান একে অন্যের ভাই, আর বিশ্বের সকল জনগোষ্ঠী মিলে এক মহাজাতি।’

হজের মধ্যে উদ্দেশ্যের ঐক্য, পোষাকের ঐক্য, ভাষার ঐক্য এবং লক্ষ্যের ঐক্য বজায় রাখার তাগিদ এবং তৎসহ মূল লক্ষ্য ব্যাহত হওয়ার মত সবকিছু থেকে দূরে থাকার তাগিদও  কোরআনে সুষ্পষ্ট ভাষায় বর্ণিত হয়েছে। যেমন ‘হজের সফরে অশোভন বা কোন অন্যায় আচরণ , ঝগড়া বিবাদ যেন না হয়।’ হাদীস শরীফের ভাষায়- ‘তোমরা পরস্পর বিদ্ধেষ পোষণ করো না, একে অন্যের মর্যাদাহানির চেষ্টা করো না। অসুস্থ প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়ো না। আল্লাহর সকল অনুগত ব্যক্তি মিলে ভাই-ভাই হয়ে বাস করো।’

হজের উল্লেখযোগ্য দুটি অনুষ্ঠান কোরবানি ও সাফা- মারওয়ার সায়ী হযরত ইসমাইল ও তার পুন্যবতী মা হাজেরার দুটো পূর্ণ স্মৃতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। মহান পিতা-পুত্র হযরত ইব্রাহিম এবং ইসমাইলের অপূর্ব ত্যাগ-তিতিক্ষার পরীক্ষা সমাপ্ত হওয়ার পর আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তাদেরকে বাইতুল্লাহ শরীফ পূনঃ নির্মাণ করার নির্দেশ দেন। কাবা ঘরের নির্মাণ কাজ সমাপ্ত হওয়ার পর হযরত ইব্রাহিমের প্রতি নির্দেশ হয়, সারা বিশ্বে হজের ঘোষণা প্রচার করার। তাকে আশ্বাস দেওয়া হলো, ঘোষণা প্রচার করা তোমার কাজ আর কিয়ামত পর্যন্ত ভক্তজনের হৃদয় কন্দরে সে ঘোষণা পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব আমার। হযরত ইব্রাহিমের সে ঘোষণার যেসব বাক্য হাদীস শরীফ থেকে জানা যায় তাতে দেখা যাচ্ছে, কোনো বিশেষ দেশ, অঞ্চল বা জনগোষ্ঠীর প্রতি তার সে আহ্বান ছিল না, এ আহ্বান ছিল সমগ্র মানবজাতির জন্য। মোট কথা, যে কোনো দিক থেকেই বিচার করা হোক না কেন হজ এমন একটা আন্তর্জাতিক অনুষ্ঠান যার বিকল্প আর কোনো কিছু কল্পনাও করা যায় না। বিশ্বে এমন আর একটা অনুষ্ঠান খুঁজে পাওয়া যাবে না, যার মধ্যে বর্ণ, ভাষা ও জাতীয়তা নির্বিশেষে পৃথিবীর সকল এলাকার সব ধরণের মানুষ এমন একমুখী এবং একাত্ম হওয়ার সুযোগ পায়।
মানুষের অন্তরে তার জন্মগত ঐক্যের অনুভূতি দৃঢ়তর করার উদ্দেশ্যেই পারস্পরিক কতগুলো প্রক্রিয়া অত্যাবশক করে দেওয়া হয়েছে। দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত মসজিদে সমবেত হওয়া, সপ্তাহে জুম্মার দিন এবং বছরে দুইবার বৃহত্তম সমাবেশ দুই ঈদের জামাতে গিয়ে হাজির হওয়া। হজ তেমনি  সর্ববৃহৎ বিশ্বজনীন সমাবেশ । যার বিকল্প পৃথিবীর বুকে
কল্পনা করা যায় না এবং ভবিষ্যতেও যাবে না। বিশ্বের সকল জাতির,সকল ধর্মের অদ্বিতীয়,একক আন্তর্জাতিক মহা সমাবেশ “পবিত্র হজ্ব” আমাদের সকলের জীবনে বয়ে আনুক অনাবিল সুখ -শান্তি ,ঐক্য এবং গড়ে উঠুক সকল বালা-মসিবত মুক্ত সুন্দর পৃথিবী।
গাজী মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম জাবির, ধর্ম ও সমাজ সচেতন লেখক, সাংবাদিক ও ধর্মীয় টিভি অনুষ্ঠান উপস্থাপক, কুমিল্লা।সংবাদ প্রকাশঃ  ০-০-২০২২ইং সিটিভি নিউজ এর  (সংবাদটি গুরুত্বপূর্ণ মনে হলে দয়া করে ফেসবুকে লাইক বা শেয়ার করুন) (If you think the news is important, please share it on Facebook or the like  See More =আরো বিস্তারিত জানতে ছবিতে ক্লিক করুন=  

(সংবাদটি গুরুত্বপূর্ণ মনে হলে দয়া করে ফেসবুকে লাইক বা শেয়ার করুন)
(If you think the news is important, please like or share it on Facebook)
আরো পড়ুনঃ