গোমতির প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে বদলে যাবে এদেশের বাণিজ্য খাত

সিটিভি নিউজের ইউটিউব চ্যানেলটি সাবস্ক্রাইব করুন

সিটিভি নিউজ।।     – শান্তনু হাসান খান=== “এই গোমতি নদীর দুইকুল বইয়া প্রতি বর্ষায় আমাগো কুমিল্লার ২৬টি ইউনিয়ন এতো বেশি প্লাবন হয়- যে, খেতের ফসল আর ঘরে উঠাইতে পারি না …..।” দমদেয়া রেকর্ডের মতো থেমে থেমে কথাগুলো বলছিলেন- সীমান্তবর্তী এলাকা গোলাবাড়ীর রমিজ মিয়া। কৃষক রমিজ মিয়া কুমিল্লা সদরের পাঁচথুবী ইউনিয়নের বাসিন্দা। বাপ-দাদার আমল থেকেই কৃষক তিনি। গোমতির চরে শীতকালীন আবাদে তার নাম ডাক আছে। বললেন-নদীতে এতো পলি আর বালু আইস্যা দুই কুল ভরাট করে। ফলে অতি বর্ষণে ত্রিপুরার সব পানি আমাদের এই দিকে তলাইয়া রাখে। যদি গোমতির ড্রেজিংটা প্রতি বছর হয়-তা হলে এই কষ্ট আর থাকবো না।
গোমতির পূর্ব সীমান্তে বাংলাদেশের গোলাবাড়ী কটক বাজার। ওপারে নদী গেছে আরো অনেক দূরে। তবে ইদানিং নদী নিয়ে কাজ হচ্ছে।
বাংলাদেশের পূর্ব সীমান্তে ত্রিপুরা আর আসামের কিছু অংশ। তবে ভারতের সেভেন সিস্টারের নামে খ্যাত উত্তর পূর্ব ভারতের অরুনাচল, আসাম, মনিপুর, মেঘালয়, নাগাল্যান্ড আর ত্রিপুরা রাজ্য। তবে বাংলাদেশের জীবন যাত্রা আর সংস্কৃতির সাথে ত্রিপুরা ও আসামের মানুষদের সাথে অনেকটা মিল থাকার কারণে দু’দেশের ভ্রাতিত্ববোধটা বহুলাংশে সমাদৃত। স্বাধীনতা সংগ্রাম কালে আসাম আর ত্রিপুরার জনগণ বাংলাদেশী শরনার্থীদের ব্যাপক সহযোগিতার কারণে সৌহার্দ্যপূর্ণ অবস্থার সৃষ্টি হয়ে আসছে দীর্ঘদিন। সেই সুবাদে দু’দেশের যোগাযোগ আর ব্যবসা বাণিজ্যের ক্ষেত্রে অনেকটা এগিয়ে গেছে। ফলে ট্রানজিট আর ইমিগ্রেশনে এসেছে সফলতা। এই সফলতার পেছনে প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার আমলে আরো একধাপ এগিয়ে গেছে।
ভারতের পূর্বাঞ্চলের সাথে এদেশের পণ্য আমদানী রপ্তানি বাড়াতে আগে থেকে সিলেটের জাফলং-ডাউকি সীমান্ত আর আখাউড়ার-আগরতলা চেক পোস্ট ব্যবহৃত হয়ে আসছে সড়ক পথে। তবে এবার নৌপথে আরো প্রসার ঘটাতে কুমিল্লার গোমতী নদী দিয়ে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের সাথে পরীক্ষামূলক নৌ বাণিজ্য শুরু করা হয়েছে। কিন্তু নানা সংকট থাকার কারণে গোমতি নদীর খনন ছাড়া বাণিজ্যে সফলতার মুখ দেখছেন না সংশ্লিষ্ট মহল। আর তাই গোমতী নদী খননের জন্য ৭৯৭ কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা (ডি.পি.পি) পরিকল্পনা কশিনে পাঠানো হয়েছিলো নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয় থেকে। তবে পুরাতন পরিকল্পনা সংশোধন করার জন্য আর এর দফা সেটা পাঠানো হয়েছে সম্প্রতি। নতুন করে প্রকল্পের জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে ২৮৮ কোটি ৭০ লাখ। আর তা সরকারি অর্থায়নে প্রকল্পটি ২০২২ এর জানুয়ারি থেকে জুন ২০২৫ মেয়াদে শেষ হবার কথা। গোমতি নদীর নাব্যতা রক্ষার জন্য পুনরুদ্ধার প্রকল্পের আওতায় এমন উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়-যা সকল প্রক্রিয়া ইতিমধ্যে শেষ করা হয়েছে। হয়তো যে কোন সময় প্রকল্পটি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি বা একনেক সভায় উপস্থাপন করা হবে।
এ প্রসঙ্গে নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের সচিব মোহাম্মদ মেজবাউদ্দিন চৌধুরী বলেন-নৌপথ মানেই হলো পণ্য পরিবহনের ব্যয় সাশ্রয় করা এবং সময় বাচানো। সেই আলোকে গোমতি নদী খনন করা হলে এর মাধ্যমে ত্রিপুরাসহ ভারতের পূর্বাঞ্চলের ৭টি প্রদেশে রপ্তানি আমদানীতে অনেক মুনাফা সৃষ্টি হবে-তখন দু’দেশের ব্যবসায়ীরাসহ জনগণ উপকৃত হবে অনেক বেশী।
এদিকে নৌপরিবহন সূত্রে জানা গেছে-গোমতি নদীর উৎপত্তি স্থল ত্রিপুরা হলেও বাংলাদশের কুমিল্লার পাঁচথুবী, জগন্নাথপুর, দেবিদ্বার, কোম্পানীগঞ্জ হয়ে প্রায় ১৫০ কি. মি. সর্পিল পথ পেরিয়ে দাউদকান্দির ‘সাপটা’ এলাকায় মেঘনা নদীর সাথে মিশে গেছে। ত্রিপুরার উত্তর প্রান্তে পার্বত্য অঞ্চল ডুমুর নামক স্থান থেকে গোমতির যাত্রা শুরু। এরপর ত্রিপুরার সিপাহীজালা জেলার সোনামুড়া হয়ে বাংলাদেশের দাউদকান্দি পর্যন্ত ৯৩ কি.মি. দীর্ঘ এ নদী। এ নদীর মাধ্যমে বর্ষা মওসুমে প্রচুর পাহাড়ী বালু স্রোতে ভেসে আসে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। ফলে বিভিন্ন এলাকায় গোমতির বালু মহল থেকে অনেক টাকা রাজস্ব আয় হয়ে আসছে দীর্ঘদিন। যদি নদী খনন করা হয়- তবে নাব্যতা বৃদ্ধি পাবে এবং বালু মহলের সংখ্যাও বৃদ্ধি পাবে। প্রকৃতির এই নিয়মে বাংলাদেশের মানুষদের আর্থিক সুবিধা বেড়ে যাবার সম্ভাবনাও কম নয়। গোমতি বাংলাদেশের অংশে ৮৯.৫ কি.মি. অংশ বাকি অংশ ত্রিপুরার। আর এতে বর্তমানে ৫০ টন ওজনের পণ্যবাহী নৌযান চলতে সক্ষম। আগামীতে খনন প্রকল্প শেষ হলে ২০০ থেকে ৪০০ টনের নৌযান চলাচলের উপযোগী হবে বলে আশা করা যায়-কিন্তু গোমতী নদীর নাব্য সংকট ও কয়েকটি কম উচ্চতার সেতুর কারণে পণ্যবাহী নৌযান সোনামুড়া বন্দরে পৌছাতে সমস্যায় পড়ে। এ অবস্তায় নৌপথটি খনন করা গেলে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সাতটি রাজ্যে সিমেন্ট ও ভোজ্যতেলসহ পণ্য পরিবহন সহজ হবে এবং খরচও কম পড়বে বলে অভিমত ব্যবসায়ীদের।
প্রকল্পের আওতায় বিআইডব্লিউটিএ ড্রেজার দিয়ে ক্যাপিটাল ও মেইনটেইনেস্স ড্রেজিং ৪৫ ঘনমিটার, কনসালটেন্সি সেবা ১১২ জনমাস, প্রকৌশল জরিপ, হাইড্রোগ্রাফিক জরিপ, মাটির ডাইক নির্মাণ ১৫১ লাখ ঘন মিটার, বেসরকারি ড্রেজার-এক্সেবেটর দিয়ে দিয়ে ক্যাপিটাল ও মেইনটেইনেন্স ড্রেজিং ১০৬ লাখ ঘনমিটার, নদীর তীরে বাঁধের ওপরে মাটি অপসারণ করা হবে ২০ লাখ ঘনমিটার। এছাড়া প্রকল্পের আওতায় ডাবল কেবিন পিকআপ একটি, ল্যান্ড, সিঁড়ি ও র‌্যাম ১০টি, খনন সহায়ক কাজ, যানবাহনের জ্বালানি ও অফিস সরঞ্জামসহ ইত্যাদি কার্যক্রম অন্তর্ভূক্ত রয়েছে।
এসব বিষয়ে ইতোমধ্যে প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটি (পিইসি) সভা অনুষ্ঠিত হযেছে। বাংলাদেশ অভ্যন্তরীন নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) সদস্য প্রকৌশলী ড. একেএম মতিউর রহমান বলেন, এই নৌপথের উন্নয়নের ফলে কুমিল্লা জেলার বিভিন্ন এলাকায় পণ্য পরিবহন বাড়বে। পাশাপাশি ভারতের ত্রিপুরাসহ অন্যান্য রাজ্যে রপ্তানি পণ্য বিশেষ করে সিমেন্ট রপ্তানিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে গোমতী নৌপথ। ইতোমধ্যেই প্রকল্পের পিইসি সভা হয়েছে। একনেকে অনুমোদনের পর প্রকল্পের কাজ শুরু হবে বলে আশা করা যায়-আর তখনই দু’দেশের বাণিজ্য খাতের প্রবাহ বাড়বে।
গোমতী নদীকে কেন্দ্র করে কুমিল্লার বেশ কয়েকটি উপজেলার চরের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে শতীকালীন সবজী চাষ ছাড়াও হরেক রকমের ফসলাদি উৎপন্ন হয়ে আসছে দীর্ঘদিন যা এ অঞ্চলের প্রতিটি ফসলের বাম্পার ফলন হিসাবে পরিচিতি লাভ করে আসছে অনেকদিন থেকে। ড. আইনুন নিসাত বলেন- দেশের যেকটি নদী আছে, তার মাঝে জোয়ার-ভাটা নেই- এমন নদীর মাঝে করোতোয়া, বাঙ্গালী নদী, পূর্ণভবা আর গোমতি নদী অন্যতম। এই নদী ভরাট হওয়ার একমাত্র কারণ, ভারত থেকে বয়ে আসা প্রচুর পলিমাটি আর বালু। গোমতীর বালুর একটা ঐতিহাসিক যোগ রয়েছে। এটা বাংলাদেশের অর্থনীতিতে অনেক প্রভাব ফেলে।
গোমতিকে কেন্দ্র করে নদীর আশ-পাশের প্রান্তিক মানুষদের জীবন যাত্রাও ব্যতিক্রম। যা দেশের ইতিহাস আর ঐতিহ্যকে ধরে রেখেছে দীর্ঘদিন।  সংবাদ প্রকাশঃ  ০২-০-২০২২ইং সিটিভি নিউজ এর  (সংবাদটি গুরুত্বপূর্ণ মনে হলে দয়া করে ফেসবুকে লাইক বা শেয়ার করুন) (If you think the news is important, please share it on Facebook or the like  See More =আরো বিস্তারিত জানতে ছবিতে ক্লিক করুন=  

Print Friendly, PDF & Email