কুপি বাতিই তাদের ভরসা ; আবেদনের ৫ বছর পরও বিদ্যুৎ পায়নি দেবীদ্বার পৌরসভার ৪ পরিবার

সিটিভি নিউজ।।     এবিএম আতিকুর রহমান বাশার  সংবাদদাতা জানান =====
কুমিল্লার দেবীদ্বার পৌর এলাকায় আবেদনের ৫ বছর পরও বিদ্যুৎ সংযোগ পাননি ৪ পরিবার। ফলে ‘কুপি বাতি’ ‘হারিকেন’ মোম বাতি’ই তাদের একমাত্র ভরসা।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ২১মার্চ দেশের বৃহত্তম ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াটের পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রটি উদ্বোধনের মাধ্যমে দেশের শতভাগ জনগণকে বিদ্যুতের আওতায় আনার ঘোষণা দিয়েছেন। বিদ্যুৎকেন্দ্রটি চালু করার মাধ্যমে বাংলাদেশ মুজিববর্ষে দেশকে শতভাগ বিদ্যুতের আওতায় আনার সরকারের অঙ্গীকার বাস্তবায়ন করে আরেকটি মাইলফলক প্রতিষ্ঠা করলেন। ওই অর্জনের পুরস্কার হিসেবে বিদ্যুৎ মন্ত্রনালয়ের পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রীকে ‘মেমেন্টো’ উপহার দেওয়া হয়েছিল।
ঠিক তখনও দেবীদ্বার পৌর এলাকার পোনরা (উত্তর পাড়া) গ্রামের ৪ পরিবারের ১৭ জন অধিবাসী বিদ্যুৎ বিহীন অবস্থায় মনবেতর জীবন যাপন করছেন। ওই ৪ পরিবারে ৮ সদস্য স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসার শিক্ষার্থী।
গত ১০ বছর ধরে ওই বাড়ির চারপাশের লোকজন যখন বিদ্যুতের আলোয় আলোকিত, তখন বাবরী মিয়ার বাড়ির তিন পরিবারের ১৭ সদস্য কুপি বাতি, হারিকেন ও মোম বাতির আলোর সাহায্যে মানবেতর জীবন যাপন করতে হচ্ছে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির এ যোগে ইন্টারন্যাট সংযোগের বিকল্প নেই। সে ক্ষেত্রে ওই ৪ পরিবারের সদস্যরা ইন্টারন্যাট জগত থেকে সম্পূর্ণ অন্ধকারে রয়েছে।
ভোক্তভূগী পরিবারের প্রধান বাবরি মিয়া জানান, প্রায় ৩০ বছর পূর্বে আবাসন পরিবর্তন করে এ এলাকায় ৩০ শতাংশ জমি কিনে বাড়ি নির্মাণ করি। স্ত্রী ও তিন পুত্র নিয়ে এ বাড়িতে বসবাস করে আসছি। এরই মধ্যে বংশ বৃদ্ধিতে ৬ নাতী ও ৩ নাতনীসহ পরিবারের সদস্য সংখ্যা বর্তমানে ১৭ জন। তিন ছেলেই আলাদা থাকেন। আমিও আমার স্ত্রীকে নিয়ে আলাদা থাকি। প্রায় ১০ বছর পূর্বে প্রতিবেশীরা বিদ্যুতায়নের অন্তর্ভূক্ত হলেও আর্থিক অসচ্ছলতার কারনে বিদ্যুৎ সংযোগ নিতে পারি নাই। প্রতিবেশী মোঃ হুমায়ুন কবির’র জমিতে বৈদ্যুতিক খুটি থাকায় ওই খুটি থেকে বিদ্যুৎ সংযোগ দিচ্ছেনা।
বাবরি মিয়ার বড় ছেলে নাছির উদ্দিন জানান, তাদের বাড়ির ১১ পরিবার গত ২০১৭ সালের ১২ নভেম্বর বিদ্যুৎসংযোগ পেতে স্থানীয় বিদ্যুৎ অফিসে আবেদন করেন। বিদ্যুৎ অফিস থেকে ১১টি বৈদ্যুতিক মিটার অনুমোদন পেলেও প্রতিবেশী প্রভাবশালী হুমায়ুন কবির ও তার পরিবারের প্রতিরোধে তাদের চার পরিবার বিদ্যুৎ সংযোগ পাননি। অপরাধ সরকারী সড়কের পাশে দুই ফুট ভেতরে হুমায়ুন কবিরদের নিজস্ব জায়গায় বৈদ্যুতিক খুটিটি থাকায় তারা তাদের জায়গা থেকে বিদ্যুৎ সংযোগ দেবেনা। এতে যদি দুই একজন খুণও হয় তাতেও দেবনা।
অভিযুক্ত হুমায়ুন কবির’র সাথে মুঠু ফোনে যোগাযোগ করলে তিনি জানান, আমি যেমন জমি কিনে বাড়ি করেছি, তেমনি বাবরি মিয়াও জমি কিনে বাড়ি করেছেন। আমার কেনা ১৫ শতক জমি মাঠ জরিপে ১২ শতক হয়ে যায়, আর বাবরি মিয়ার জমি ঠিক থাকে এ কেমন করে হয়। আমার বাকী ৩শতক জমি বাবরি মিয়ার দখলে, ওই জমি যতক্ষন না ফেরত দেবেন ততক্ষণ বিদ্যুৎ সংযোগ পাবেনা।
পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি (কুমিল্লা) চান্দিনা-১’র দেবীদ্বার জোনাল অফিসের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার প্রকৌশলী শ্রী দিপক কুমার সিংহ বলেন, প্রায় দু’বছর পূর্বে দেবীদ্বারকে শতভাগ বিদ্যুতায়নের আওতায় আনা হয়। বাবরি মিয়ার বাড়ির ৪ পরিবার এখনো বিদ্যুৎ সংযোগ থেকে বঞ্চিত রয়েছে। প্রায় চার দফা এজিএম, ঠিকাদার, পুলিশ ও আমিসহ বিপুল জনবল নিয়ে বিদ্যুৎ সংযোগ দিতে গিয়ে ফিরে আসতে হয়েছে। ওই বাড়ির প্রায় ৩০/৪০জন মহিলা এসে অকথ্য ভাষায় গালমন্দই নয়, কাজ করতে গেলে বৈদ্যুতিক খুটি জড়িয়ে ধরে রাখে। কর্তব্যকাজে বাঁধাদানের অভিযোগে আমি নিজে বাদী হয়ে হুমায়ুন কবির সহ কয়েকজনকে অভিযুক্ত করে থানায় মামলা করেছি। বিদ্যুৎ সংযোগ নিরাপদ করতে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, জিএমসহ উর্ধতন কর্মকর্তাদের লিখিত অভিযোগে অবহীত করেছি। এ ঘটনায় স্থানীয় সাংসদের পিতা সাবেক মন্ত্রী, এমপি ও আ’লীগ নেতা এএফএম ফখরুল ইসলাম মূন্সী, আবুল কাসেম চেয়ারম্যানসহ এলাকার গন্যমান্য ব্যক্তিগন সালিসেও তার সমাধান দিতে পারেননি বলেও শোনেছি।
দেবীদ্বার থানার অফিসার ইনচার্জ মোঃ আরিফুর রহমান এর সাথে মুঠু ফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেও কথা বলা সম্ভব হয়নি।
পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি (কুমিল্লা) চান্দিনা-১’র জেনারেল ম্যানেজার মোঃ মুকবল হোসেন ক্ষোভের সাথে জানান, আমার লোকজন ঠিকাদার এবং পুলিশ নিয়ে বিদ্যুৎ সংযোগ দিতে ৪ বার গিয়েছেন। একটি পরিবারের প্রতিরোধে বিদ্যুৎ সংযোগ দেয়া সম্ভব হয়নি। আমার লোকজন নিরাপত্তাহীন। বৈদ্যুতিক খুটিসহ মালামাল ঘটনাস্থলেই পড়ে আছে। এ ব্যপারে ইউএনওকে অবহীত করা হয়েছে। এখন পুলিশের ভুমিকা কি তা আপনারা থানা পুলিশ থেকে জানতে পারেন।
এব্যপারে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ আশিক-উন-নবী তালুকদার জানান, পল্লীবিদ্যুতের লোকজন যখন বিদ্যুৎ সংযোগ দিতে যাবে তখন সমন্বয় করে যেতে হবে। নির্বাহী ম্যাজিেেষ্ট্রট, পুলিশ, পল্লীবিদ্যুতের লোকজন একসাথে টাস্কফোর্স গঠন করে গেলে সমস্যা থাকার কথা নয়। আমাকে কখনো ওভাবে বলা হয়নি।
রোববার রাতে দেবীদ্বার পৌর এলাকার পোনরা গ্রামের বাবরি মিয়ার বাড়ি দেখতে সরেজমিনে যেয়ে দেখা যায়, বাড়িটি একটি ভুতুরে বাড়ি, বাঁশঝার আর গাছ গাছালিতে ভরপুর অন্ধকার বাড়িতে পা রাখতেই গা ছম ছম করছে। একটু ভেতরে ঢুকেই শোনা যায় কুপি বাতি, হারিকেন, মোমবাতির নিভু নিভু আলোয় ছোট ছোট ঘরে শিক্ষার্থীদের পড়ার শব্দ।
বাড়ির একমাত্র অসুস্থ্য মুরুব্বী বাবরি মিয়া (৮০) মোমবাতি জ¦ালিয়ে নামাজ শেষে ঘরের মেঝেতে বসে খাবার খাচ্ছেন। অপর ঘর থেকে শুনতে পাই এক অসুস্থ্য বৃদ্ধা মহিলা কমলা বিবি (৬৫) টয়লেটে যাবে। মোম এবং কুপি বাতি নিয়ে তাকে টয়লেটে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলেও বাতাসে আলো নিভে যায়, পরে অন্য একজন মোবইলের টর্চের আলোতে সহযোগীতা করছেন।
পাশের ঘরে ঢুকে দেখা যায় দিনমজুর তাছির মিয়ার স্ত্রী হোসনেয়ারা বেগম চৌকিতে মোমবাতি জ¦ালিয়ে তার পুত্র প্রথম শ্রেণীর ছাত্র ইয়াছিনকে পড়াচ্ছেন। ইয়াছিন বারুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পড়ে। হোসনেয়ারা বলেন, গরমে সেদ্ধ হয়ে যাচ্ছি, হাতে হাতপাখা নিয়েও সন্তানকে বাতাস দিতে পারছিনা, মোমবাতি নিভে যাবে। পাশের টেবিলে কুপি বাতির আলোতে পড়ছেন জুয়েল রানা, সে এলাহাবাদ মহা বিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। জুয়েল জানায় তাদের অনেক কষ্ট করে লেখাপড়া করতে হয়। টেবিলের অভাবে তার একমাত্র বোন পাপিয়া আক্তার দাদার ঘরে পড়ছে। পাপিয়া বারুর আলী হোসেন উচ্চ বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণীর ছাত্রী।
কৃষক নাছির উদ্দিনের ঘরে ঢুকে দেখা যায় তার স্ত্রী আনোয়ারা বেগম বারুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়–য়া পুত্র প্রথম শ্রেণীর ছাত্র নাফিজকে মেঝেতে বসে হারিকেনের আলোয় পড়াচ্ছেন। এক মাত্র মেয়ে পান্না আক্তার দশম শ্রেণীতে পড়া অবস্থায় বিয়ে হয়ে যায়। বড় ছেলে মোঃ পারভেজ ভূষণা আদর্শ টেকনিক্যাল এন্ড বিজনেসম্যান্ট কলেজে দ্বিতীয় বর্ষে পড়ে।
আর একটু ভেতরে নির্জন ঘরে প্রবেশ করে দেখা যায়, সিএনজি চালক বাছির উদ্দিনের দুই ছেলে শাহাদাত হোসেন ও সায়মন হোসেন একটি ছোট টেবিলে বসে কেরোসিনের কুপি বাতির আলোতে লেখাপড়া করছে। শাহাদাত বারুর আলী হোসেন উচ্চ বিদ্যালয়ে দশম শ্রেণীতে এবং সায়মন বারুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চতুর্থ শ্রেণীতে পড়ে। পাশের কক্ষে মাশিকাড়া মাদ্রাসায় মিজান শ্রেণীতে পড়–য়া সাবিবা কুপি বাতির আলোতে পড়ছেন।

সংবাদ প্রকাশঃ  ২৫-০-২০২২ইং সিটিভি নিউজ এর  (সংবাদটি গুরুত্বপূর্ণ মনে হলে দয়া করে ফেসবুকে লাইক বা শেয়ার করুন) (If you think the news is important, please share it on Facebook or the like  See More =আরো বিস্তারিত জানতে ছবিতে/লিংকে ক্লিক করুন=  

(সংবাদটি গুরুত্বপূর্ণ মনে হলে দয়া করে ফেসবুকে লাইক বা শেয়ার করুন)
(If you think the news is important, please like or share it on Facebook)
আরো পড়ুনঃ