সিটিভি নিউজ।। এবিএম আতিকুর রহমান বাশার সংবাদদাতা জানান ====
কানিজ ফাতেমাকে র্যাংক ব্যাজ পরিয়ে দিয়েছেন সেনাপ্রধান জেনারেল এস এম শফিউদ্দিন আহমেদ। তার এ সম্মাননা প্রাপ্তিতে নিজ গ্রাম কুমিল্লা দেবীদ্বার উপজেলার ভিংলাবাড়ী গ্রামের মানুষ খুবই আনন্দিত ও গর্বিত।
তার ইছাশক্তির কাছে শারীরিক প্রতিবন্ধকতা হার মেনেছে পদে পদে। অদম্য মনোবল দিয়ে প্রতিবন্ধকতা জয়ের এক অসাধারণ উদাহরণ এখন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মেজর কানিজ ফাতেমা।
জীবনযুদ্ধে হার না মানা দেবীদ্বারের কৃতি সন্তান ক্যাপ্টেন কানিজ ফাতেমাকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে মেজর পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে।
গত শনিবার (৪ জুন) ঢাকা সেনানিবাসের আর্মি মাল্টিপারপাস কমপ্লেক্সে সকল ফরমেশন কমান্ডার এবং সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল এস এম শফিউদ্দিন আহমেদের উপস্থিতিতে এক আড়ম্বরপূর্ণ পরিবেশে ক্যাপ্টেন পদ থেকে কানিজ ফাতেমাকে পদোন্নতি দিয়ে মেজর করা হয়।
আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদফতরের (আইএসপিরআর) এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, কানিজ ফাতেমা দেশসেবার এক বুক স্বপ্ন নিয়ে ২০১১ সালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। ১৮ সেপ্টেম্বর ২০১২ মেজর কানিজের প্রশিক্ষণ চলাকালীন দুর্ঘটনায় পতিত হয়ে মেরুদন্ডের হাড় ভেঙে যায়। ওই ঘটনার প্রেক্ষাপটে তার পক্ষে সেনাবাহিনীর কঠোর ও সুশৃঙ্খল স্বাভাবিক কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়া সম্ভবপর ছিল না। কিন্তু এই অকুতোভয় নারী, ভাগ্যের কাছে হার না মেনে দেশের স্বার্থ রক্ষায় কাজ করে যেতে দৃঢ় প্রত্যয়ী ছিলেন।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কানিজ ফাতেমার এই অদম্য উদ্দীপনাকে সম্মান জানিয়ে সব বাধা উপেক্ষা করে ৬৯ বিএমএ দীর্ঘ মেয়াদী কোর্সের সঙ্গে ২০১৩ সালে বিশেষ বিবেচনায় কমিশন প্রদান করে। পরবর্তী সময়ে কানিজ ফাতেমা হুইল চেয়ারের সাহায্যে চলাফেরা করলেও নিজের অদম্য মানসিক শক্তি এবং সহকর্মীদের সহায়তায় দৈনন্দিন কার্যক্রম স্বতঃস্ফূর্ততার সঙ্গে পালন করে আসছেন। তার ইছাশক্তির কাছে শারীরিক প্রতিবন্ধকতা হার মেনেছে পদে পদে। দেশ ও জনগণের আস্থার প্রতীক বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কর্তৃক একজন অকুতোভয় নারীর প্রতি এ বিরল সম্মাননা দেশের প্রতিটি নারীর অগ্রযাত্রায় সর্বদা অনুকরণীয় এবং ইতিহাসের পাতায় উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নারীর ক্ষমতায়নের অংশ হিসেবে সেনাবাহিনীতে ২০০০ সালে নিয়মিত সর্বপ্রথম নারী অফিসার নিয়োগ প্রদান শুরু হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৫ সাল থেকে নারী সৈনিকের সংযোজন, নারী অফিসারদের ইউনিট কমান্ড প্রদান, জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী মিশনে গুরুত্বপূর্ণ পদে নারী অফিসারদের নিয়োগসহ বিভিন্ন পদক্ষেপে দেশে নারী উন্নয়নের অগ্রযাত্রাকে ত্বরান্বিত করেছে।
সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাদের বিয়ের পর বাসা বরাদ্ধ দেয়া হয়। কিন্তু পরিস্থিতি বিবেচনায় কানিজ ফাতেমার জন্য আগেই বাসা বরাদ্ধ দেয়া হয়। ওই বাসায় মা ও ভাই বোন নিয়ে পরিবারের দায়িত্ব পালনের সঙ্গে সেনা বাহিনীতে সরকারী দায়িত্বও যথাযথভাবে পালন করে যাচ্ছেন তিনি। তার পোষ্টিং হয় সেনা বাহিনীর সাপ্লাইএন্ড ট্রান্সপোর্ট (এসটি) ব্যাটেলিয়নে। এ ব্যাটেলিয়নের ষ্টাফ অফিসার এবং ভারপ্রাপ্ত কোম্পানী কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। শারিরীক সমস্যা তার কাজে তেমন বাধা হতে পারেনি। ডেক্স জবের পাশাপাশি ফিল্ড জবও করেন তিনি। বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কর্মসূচীতে ষ্টাফ অফিসার হিসেবে তাকে উপস্থিত থেকে দায়িত্ব পালন করতে হয়। বর্তমানে তিনি সেনা বাহিনীর ৯ পদাতিক ডিভিশনের অধিন ৩৩ এসটি ব্যাটেলিয়নে কর্মরত আছেন।
কানিজ ফাতেমা (স্মৃতি) কুমিল্লার দেবীদ্বার উপজেলার ভিংলাবাড়ি গ্রামের সরকার বাড়ির মৃত: কামাল উদ্দিন সরকার এবং গৃহিনী সালমা বেগমের বড় মেয়ে। তার জন্ম ১৯৯০ সালে। পরিবারের ৪ ভাই বোনের মধ্যে কানিজ ফাতেমা সবার বড়।
সোমবার দুপুরে কানিজ ফাতেমা (স্মৃতি)’র গ্রামের বাড়ি ভিংলাবাড়ি সরকার বাড়িতে যেয়ে জানা যায়। কানিজ ফাতেমার পরিবারের কেউ বাড়িতে থাকেন না। পাকা ভিটি টিন সেট ঘরটির একাংশ ভাড়া দিয়ে পরিবারের সবাই ঢাকা সেনানিবাসে বসবাস করছেন।
কানিজ ফাতেমার ছোটচাচা মোঃ ইব্রাহীম সরকার (সেলিম)’র সাথে দেখা। তিনি জানান, স্মৃতি (কানিজ ফাতেমা) আমার বড় ভাইয়ের বড় মেয়ে। আমরা ৪ ভাইয়ের মধ্যে স্মৃতরি বাবা দ্বিতীয় ছিলেন। মেয়ে (কানিজ ফাতেমা) বাংলাদেশ সেনা বাহিনীতে যোগদানের পর একটি প্রশিক্ষনের ঝুলন্ত রসি ধরে পাড় হওয়ার সময় রসির সাথে আটকানো সিকিউরিটি বেল্ট খুলে পড়ে দূর্ঘটনায় কবলিত হয়। দূর্ঘটনায় তার মেরুদন্ডের হাড় ভেঙ্গে পায়ে চলাচলে অক্ষম হয়ে পড়ে। তার চিকিৎসা এবং মেয়ের ভবিষ্যৎ চিন্তায় দূর্ঘটনার ২০ দিনের মাথায় আমার বড় ভাই কামাল উদ্দিন সরকার হার্ট এটাকে মারা যান।
কানিজ ফাতেমার সাথে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করে কথা বলা যায়নি। তার মা’ সালমা বেগম সেল ফোনে জানান, কানিজ সেনা কর্মকর্তাদের একটি অনুষ্ঠানে আছেন। তিনি তার মেয়ের অনুমতি ছাড়া পারিবারিক কোন তথ্যপ্রদানে অসম্মতি জানান। তবে মেয়ে মেজর পদে পদোন্নতীতে তিনি খুবই আনন্দিত। সন্তানদের পরিচয় দিতে যেয়ে বলেন, আমার দ্বিতীয় মেয়ে ফারহানা ইসলাম সুচী ঢাকা এশিয়া প্যাসিফিক ইউনিভার্সিটি থেকে মাষ্টার্স শেষ করার পর বিয়ে হয়, বর্তমানে সে একটি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানীতে কর্মরত আছে। ছোট মেয়ে রোকসানা কামাল যুথি ঢাকা ইউডা ইউনিভার্সিটি থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে এখন এমএসসি পড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। এক মাত্র ছেলে ইফতেখারুল আলম সরকার ঢাকা সাভার ক্যান্টনম্যান্ট পাবলিক স্কুল এন্ড কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে এখন বাংলাদেশ সেনা বাহিনীতে চাকরি নেয়ার চেষ্টা করছে।
কানিজ ফাতেমা (স্মৃতি) মুরাদনগর উপজেলার কোম্পানীগঞ্জ বদিউল আলম উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ২০০৬ সালে এসএসসি এবং ২০০৮ সালে কোম্পানীগঞ্জ বদিউল ডিগ্রী কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করেন। পরবর্তীতে জাহাঙ্গীরনগর বিশ^বিদ্যালয় কলেজে আইপিএতে ভর্তি হন। আইপিএতে অধ্যয়নরত অবস্থায় ২০১১ সালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে চাকরিতে যোগদান করেন। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে চাকরিতে যোগদান করার উদ্দেশ্য পরিবারের হাল ধরতে নয়, দেশ সেবার মানষিকতা নিয়েই চাকরিতে যোগদান করেন। সেনাবাহিনীতে নারীদের কর্মকর্তা পদে যোগদানের সুযোগ থাকায় তিনি চাকরিতে যোগদান করেন। চাকরিতে যোগদানের কিছুদিন পরই পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম পিতা হার্ট এটাকে মৃত্যুবরণ করার কারনেই তাকে পরিবারের হাল ধরতে হয়েছে।
কানিজ ফাতেমার ছোট বোন, তার বোন সম্পর্কে কথা বলতে যেয়ে বলেন, আমাদের গ্রামের বাড়ির পাশ দিয়েই বয়েগেছে গোমতী নদী। ময়নামতি সেনানিবাসটিও ২২ কিলোমিটার দূরে। শীতকালীন প্রশিক্ষনে সেনাবাহিনীর সদস্যরা আমাদের বাড়ির পাশেই প্রশিক্ষন শিবির গেড়ে প্রশিক্ষণ নিতেন। তাদের প্রশিক্ষণ দেখেই সেনাবাহিনীতে চাকরি করার ইচ্ছে জাগে। যা ২০১৩ সালে বোন ইচ্ছা পুরনে সফল হয়েছেন।
স্থানীয় আ’লীগ নেতা বিশিষ্ট ব্যবসায়ি মোঃ কাইয়ুম ভূঁইয়া জানান, স্মৃতির বাবা কামাল উদ্দিন সরকার একজন বালু ব্যবসায়ী ছিলেন, তার যাত্রীবাহী বাসও ছিল। পরিবারটি এক সময় খুবই স¦চ্ছল থাকলেও পরিবার প্রধানের আকস্মিক মৃত্যুতে সংকটে পড়ে যায়। পরিবারের ভরন পোষনের ভার পরে কানিজ ফাতেমার উপর।
সংবাদ প্রকাশঃ ০৫-০৬-২০২২ইং সিটিভি নিউজ এর (সংবাদটি গুরুত্বপূর্ণ মনে হলে দয়া করে ফেসবুকে লাইক বা শেয়ার করুন) (If you think the news is important, please share it on Facebook or the like See More =আরো বিস্তারিত জানতে ছবিতে/লিংকে ক্লিক করুন=