সিটিভি নিউজ, এম আর কামাল, নারায়ণগঞ্জ প্রতিনিধি জানান : অনেক স্বপ্ন নিয়ে শুরু হয়েছিলো যে সংসার, সেই সপ্নের সিড়ি বেয়ে বিধাতা মায়ের কোল জুরে পাঠিয়ে দিলেন এক কন্যা সন্তান। সময়ের ব্যবধানে পরিস্ফুটিত হলো শিশুটির প্রতিবন্ধীত্ব। ভেংগে গেলো সব সপ্ন। হারিয়ে গেলো সব আপনজনদের ভালবাসা, ধীরে ধীরে সরে যেতে শুরু করলো মাথার আকাশ, এই কঠিন বাস্তবতার মাঝেই আপন প্রতিবন্ধী শিশুটি লালনপালন করতে করতেই মা উপলব্ধি করলো তার অসহায় শিশুটির মতই সমাজে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অসংখ্য প্রতিবন্ধী শিশু-কিশোরদের ও তাদের মায়েদের অসহায়ত্বের কথা।
আর এই উপলব্ধি থেকেই জন্মনিলো এক অদম্য স্পৃহা যে, এই সমাজকে জাগাতে হবে , মুক্ত কন্ঠ বলতে হবে প্রতিবন্ধী শিশু বিধাতারই দান, তাদের নির্মলতাই হউক আমাদের ভালবাসার প্রান। এই উপলব্ধি থেকেই এই নিপীড়িত মা হাসিনা রহমান সিমু প্রতিষ্ঠা করেন হাসিনা অটিজম চাইল্ড কেয়ার।
সালটা ছিলো ২০১৬ ইংরেজী, পারিবারিক, সামাজিক সব প্রতিকুলতা ভেংগে মাত্র কয়েক জন প্রতিবন্ধী নিয়ে শুরু করে ফেললেন নারায়ণগঞ্জের বন্দরে অটিজম চাইল্ড সেন্টারটি। নিজের পরিশ্রমে যতটুকু উপার্জন করেন তার প্রায় সবটুকু ঢেলে দেন এখানে। অল্প কয়েক সপ্তাহেই অনেক প্রতিবন্ধী শিশু-কিশোরদের নিয়ে তাদের অসহায় মায়েরা যোগ দিলো এই চাইল্ড কেয়ারটিতে। হাসিনা রহমান সিমুকে ঘিরে সবাই যেনো জীবনে সাহস ফিরে পেলো। এ যেন কবি নজরুলের সেই বিখ্যাত পংক্তিরই প্রতিৎধনি “ ঐ নতুনের কেতন ওরে কাল- বোশেখীর ঝড়। তোরা সব জয়ধ্বনী কর! তোরা সব জয়ধ্বনী কর! ”।
কিন্তু বাধ সাধলো বাস্তবতা, হাসিনা অটিজম চাইল্ড কেয়ারে যখন প্রতিবন্ধীদের সংখ্যা বাড়তে থাকলো, সিমুর একার সামান্য উপার্জন দিয়ে প্রতিষ্ঠানটি চালানো ও একে স্থায়ী রূপ দেওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়লো। আবারও সপ্ন ভাংগার প্রতিধ্বনি। এ যেনো বিধাতা দেখছিলেন স্বর্গ থেকে। তারই পাঠানো প্রতিবন্ধী শিশুদের নিয়ে এক মায়ের বেচে থাকার সংগ্রামকে ব্যর্থ হতে দেননি বিধাতা।
সাক্ষাৎ দেবী রূপে এই অটিস্টিক শিশুদের প্রত্যাশার স্থল হাসিনা রহমান সিমুর সামনে ভরসার প্রতীক হয়ে স্নেহের হাত বুলিয়ে দেন আরেক মহীয়সী নারী। মাতৃ স্নেহে তাকে বুকে টেনে নেন। হ্যা সিমুর জীবনের এই মাতৃরুপি দেবী আর কেহ নন, তিনি হলেন নাসরিন ওসমান। কঠিন সংগ্রামে ক্লান্ত অটিজম জননী সিমু যেন মায়ের স্নেহে প্রেরনা ফিরে পেলেন। আর দুঃখী মেহনতী মানুষের আলোর দিশারি সেলিম ওসমান পিতার মমত্ব নিয়ে কাছে টেনে নিলেন তাকে। নাসরিন ওসমান নিজের তরফ থেকে সিমুর হাতে তুলে দিলেন অনুদান। নাসরিন ওসমানের স্নেহে নতুন করে উদ্দিপনা ফিরে পান সিমু , সেই থেকে তার ৫ বসরের ক্লান্তিহীন কর্মজজ্ঞে আজ ১১৭ জন সরকার কর্তৃক স্বীকৃত প্রতিবন্ধী ও ৭ জন শিক্ষক শিক্ষয়িত্রী নিয়ে জেলার বৃহত্তম অটিজম প্রতিষ্ঠানটি পরিচালিত হচ্ছে।
এই দীর্ঘ ৫ বসরের যাত্রা পথে অটিজম চাইল্ড কেয়ারটি চালাতে গিয়ে হাসিনা রহমান সিমু নিজের সমস্ত আয় রোজগার ব্যয় করে ফেলেন, চরম আর্থিক প্রতিকুলতার মাঝেও স্নেহময়ী মা নাসরিন ওসমানের দেওয়া অনুদানের অর্ধেকেরও বেশী অর্থ পরম যতেœ রেখে দেন প্রতিষ্ঠানটির স্থায়ী স্থাপনার জন্যে।
আর সিমুর এই সততা ও ত্যাগই এক সময় কুলোষিত কিছু মানুষের যড়যন্ত্রের ফাঁদে ক্ষতবিক্ষত হতে থাকে কিন্তু তা এই অটিজম জননীর সংগ্রামী জীবনকে থামাতে পারেনি, যড়যন্ত্রের ঝড় সিমুর ব্যক্তি সুখ সপ্ন সংসার সব কেড়ে নিলেও শত প্রতিবন্ধীদের নিয়ে নতুন করে গড়া বিশাল সংসার নিয়ে কঠিন একযাত্রায় সম্মুখপানে এগিয়ে চলেছেন তিনি , এ যাত্রা কবে শেষ হবে তিনি জানেন না। এই অটিজম জননীর কানে শুধু ধ্বনিত হয়, যেন সন্তানরা তাকে বলছে— “পথের ক্লান্তি ভুলে, স্নেহ ভরা কোলে তব
কোথায়ও অটিজম শব্দটা উচ্চারিত হলেই যে নামটা সবার চোখে ভেসে উঠে তিনি হচ্ছেন নারায়ণগঞ্জের বন্দরে অবস্থিত হাসিনা অটিজম চাইল্ড কেয়ারের প্রতিষ্ঠাতা হাসিনা রহমান সিমু, যিনি জনমানুষের কাছে অটিজম জননী নামেই বেশী পরিচিত।
হঠাৎ কেহ তাকে দেখলে মনে করবে যেন গ্রীক পুরানের প্রেম ও সৌন্দর্যের দেবী আফ্রোদিতি নেমে এসেছে যাকে গ্রীক সাহিত্যে সমুদ্রস্রোতের ফেনিলতা থেকে জন্মানো ভালবাসার প্রতীক মনে করা হয়। আর এটা সত্যিই মনে হয় যখন দেখা যায় সমাজ সংসারের শত প্রতিকুলতাকে ডিংগিয়ে দুস্টচক্রের পরশ্রীকাতরতা, হিংসা আর অপবাদের মুকুট ধারন করেও তিনি নির্বিঘেœ অটিস্টিক শিশুদেরকে মাতৃস্নেহে আবদ্ধ করে তাদের অধিকারের সংগ্রামে এগিয়ে চলেছেন।
অটিজম চাইল্ড কেয়ারের কার্যক্রম পরিচালনা করা সাধারণ স্কুলগুলো থেকে কিছুটা ভিন্ন। অটিস্টিক শিশু-কিশোররা অধিকাংশই শারীরিক ও মানুষিক স্বাভাবিকতার অভাবে অপরের সাহায্য ব্যাতিত অটিজম চাইল্ড কেয়ারে আসতে পারেনা। কোন কোন ক্ষেত্রে তাদের চলাচলের জন্যে সহায়তা ইন্সট্রুমেন্ট প্রয়োজন পরে যেমন হুইল চেয়ার, ট্রাইসাইকেল, ক্র্যাচ, স্ট্যান্ডিং ফ্রেম, ওয়াকিং ফ্রেম, সাদাছড়ি, এলবো ক্র্যাচ শ্রবন যন্ত্র ইত্যাদি। পরিবারের কেহ সময় দিতে না পারলে অটিস্টিকদের বাহিরে নিরাপদে বের হওয়া সম্ভব হয়না, আবার কখনো কখনো অসুস্থতার কারনেও বের হতে পারেনা। এই সব কারনে হাসিনা রহমান সিমুকে তাদের সাথে নির্ধারিত স্কুল সময়ের বাহিরেও যোগাযোগ রক্ষা করতে হয় । তাছাড়া তাকে সরকার সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান গুলোর সাথেও প্রয়োজনীয় যোগাযোগ রক্ষা করতে হয়।
নিয়মিত স্কুল কার্যক্রমের বাহিরে স্থানীয় প্রশাসন কর্তৃক আয়োজিত জাতীয় দিবস গুলোতে সিমুর নেতৃত্বে গত ৫ বসর যাবত প্রতিবন্ধীদের নিয়মিত অংশ গ্রহন ইতিমধ্যে সমাজের সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। সুস্থ বাচ্চাদের সাথে পাল্লা দিয়ে হাসিনা অটিজম চাইল্ড কেয়ারের অটিজম শিশুরা প্রতি সময়ই পদক জিতেন।
নিজের কষ্টার্জিত উপার্জন দিয়ে প্রতি বছর সমস্ত প্রতিবন্ধীদের নিয়ে জাতির পিতার জন্ম উৎসব পালন করেন। এই অটিস্টিক শিশুদেরকে জাতির পিতার সাথে পরিচিত করতে সাহায্য করেন।
এইভাবে অটিজম নিয়ে কাজ করতে গিয়ে ধীরে ধীরে হাসিনা রহমান সিমু যখন সামাজিক চোখে সম্মান ও ভালবাসার আসনে অধিষ্ঠিত হতে থাকে তখনই সে কিছু হতাশাগ্রস্ত দুস্ট চক্রের হিংসা ও পরশ্রীকাতরতার স্বীকার হতে থাকেন।
কিন্তু তার অদম্য সাহস আর প্রতিবন্ধীদের প্রতি ভালবাসা আর সমাজের ভালো কিছু মানুষের সমর্থনই আজও তাকে এগিয়ে যেতে সাহায্য করছে।
এইতো কয়েক সপ্তাহ আগের কথা, সময়টা ছিলো ২৪ শে ফেব্রুয়ারি ২০২০ইংরেজি। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সাবেক প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল হারুন অর রশিদ সোনারগাঁও লোক যাদুঘরের সবুজ প্রান্তরে বসে আছেন। সাথে তার মেয়ে। পরন্ত বিকেলে বাপ আর মেয়ে অবাক হয়ে দেখছিলেন আনন্দ ভ্রমনে আসা হাসিনা অটিজম চাইল্ড কেয়ারের অটিস্টিক শিশু-কিশোরদের বিনোদন মুলক কার্যক্রম। আদর স্নেহে কাছে টেনে নিচ্ছিলেন এক একটি অটিস্টিক শিশুকে, কথার ফাকে যখনই জেনারেল সাহেব তাদেরকে হাসিনা রহমান সিমুকে দেখিয়ে জিজ্ঞেস করছিলেন উনাকে চিনো? কে উনি, প্রত্যেকের একই উত্তর ছিলো, সে আমার মা। অবাক হয়েছিলেন জেনারেল হারুন। পরবর্তীতে ২৮শে ফেব্রুয়ারী নারায়ণগঞ্জে একটি অনুষ্ঠানে এসে ঐদিনের অভিজ্ঞতা বর্ননা করতে গিয়ে জেনারেল হারুন আবেগ আগ্রুত হয়ে বলেন কতটুকু স্নেহ আর মমতা দিয়ে বাধলে প্রতিবন্ধী শিশু-কিশোর গুলো সিমুকে মা বলে ডাকে।
এইভাবেই সিমুর কাজের মূল্যায়ন করেছিলেন এই মেজর জেনারেল।
শুধু কি জেনারেল হারুন, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের মাননীয় বিচারপতি মীর হাসমত আলী, অতিরিক্ত অর্থসচিব শহিদুল হারুন, ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম, সাবেক সেনা প্রধান কে এম শফিউল্লাহ, মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ সহ বহু জাতীয় ব্যক্তিত্ব নিয়মিত এই অটিজম চাইল্ড কেয়ারটির খোঁজ খবর রাখছেন ও হাসিনা রহমান সিমুকে উৎসাহ দিচ্ছেন। নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন, জেলা পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, চেম্বার অফ কমার্স সাংবাদিকবৃন্দ ও সমাজ কল্যাণ অধিদপ্তরের সহযোগিতা ও পরামর্শ তার কাজে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে।
এই অটিজম জননীকে তার মানবিক কাজের স্বীকৃতি দিয়ে গত ৬ই ডিসেম্বর ২০২০, অল ইন্ডিয়া মহত্মা গান্ডি ইন্সটিটিউট ভারতের কলকাতায় এক অনাড়ম্বরপুর্ন অনুষ্ঠানে সম্মাননা প্রদান করেন। ইউনাইটেড মুভমেন্ট ফর হিউম্যান রাইটস, ইউনিটি ফর ইয়াং জার্নালিস্ট এসোসিয়েশন সহ বহু জাতীয় পর্যায়ের প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে তাকে সম্মান জানানো হয়।
হাসিনা রহমান সিমু গত ৫ বসরে বহু জাতীয় ব্যক্তিত্ব ও নারায়ণগঞ্জের প্রায় সমস্থ গুরুত্বপূর্ন ব্যক্তিত্বদের হাসিনা অটিজম চাইল্ড কেয়ারে ভিজিট করিয়ে সবাইকে অটিজম সম্পর্কে বাস্তবিক ধারনা দিতে চেস্টা করেছেন।
গত ৫ বছর যাবত হাসিনা রহমান সিমু প্রধানমন্ত্রীর গণভবন থেকে জেলা প্রশাসন, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব থেকে মানুষের দুয়ারে-দুয়ারে, বিভিন্ন সামাজিক ,সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানাধিতে বিরামহীন ভাবে বিচরণ করে নারায়ণগঞ্জের মানুষদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চেস্টা করেছেন যে, অটিজম কোনো রোগ নয় কিংবা কোন পাপ বা অভিশাপও নয়। এটি একটি ডিজঅর্ডার। তবে নিবিড় পরিচর্যা ও উপযুক্ত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে একজন অটিস্টিক শিশুকে অনেকাংশেই স্বাভাবিক শিশুদের মতো গড়ে তোলা যায়। তবে এক্ষেত্রে আরও যে বিষয়গুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তা হলো, অটিস্টিক শিশুদের প্রতি সহানুভূতি ও সাহায্যকারী মনোভাব। তাদের প্রতি কখনোই বিরক্ত হওয়া যাবে না। প্রতিটা কাজে তাদের সাহায্য করতে হবে এবং তাদের মধ্যে এই ধারণাটি ঢুকিয়ে দিতে হবে যে, তারাও আমাদের মতো মানুষ, তারাও সব কাজ করতে সক্ষম।
হাসিনা রহমান সিমুর এই ভাবে ৫ বসরের বিরামহীন ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় আজ নারায়ণগঞ্জের জনগন ও প্রশাসন অটিজম সম্পর্কে অনেক বেশী সচেতন। তাইতো আজ উনি নারায়ণগঞ্জের জনগনের হৃদয়ে অটিজম জননী হিসেবে অভিসিক্ত।
সংবাদ প্রকাশঃ ১৪–৬–২০২০ইং । (সংবাদটি গুরুত্বপূর্ণ মনে হলে দয়া করে ফেসবুকে লাইক বা শেয়ার করুন) (If you think the news is important, please share it on Facebook or the like সিটিভি নিউজ@,CTV NEWS24 এখানে ক্লিক করে সিটিভি নিউজের সকল সংবাদ পেতে আমাদের পেইজে লাইক দিয়ে আমাদের সাথে থাকুন। সিটিভি নিউজ।। See More =আরো বিস্তারিত জানতে লিংকে ক্লিক করুন=