পদ্মা সেতু ঃ সুদিনের আশায় ঝালকাঠির সবজি চাষীরা

সিটিভি নিউজ।।     মো.নজরুল ইসলাম,ঝালকাঠি ঃ     পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর পরই উন্মুক্ত হবে ঝালকাঠির সঙ্গে সড়কপথে রাজধানী ঢাকার যোগাযোগের সবকটি বাণিজ্যিক পথ। বিশেষ করে জেলার কৃষি খাতে ঘটবে কৃষি বিপ্লব। এমনটাই স্বপ্ন দেখছে ঝালকাঠির সবজি চাষীরা। তাই তারা সুদিনের অপেক্ষায়।
ঝালকাঠি কৃষি সম্প্রসারন অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ি জেলায় ২০২১-২২ অর্থ বছরে বোরো ধানের উৎপাদন ৫১ হাজার ৮২৯.৪৫৮ মে. টন। শীতকালীন সবজি ৮ হাজার ৩৪৬ হেক্টর জমিতে ১ লাখ ৬০ হাজার ৬৬০.৫ মে. টন উৎপাদন হয়। ২০১৯-২০ অর্থ বছরের পরিসংখানে দেখা যায় জেলায় দক্ষিানাঞ্চলের উল্লেখযোগ্য অর্থকারি ফল হিসাবে প্রায় ৮শ হেক্টর জমিতে প্রায় ৯ হাজার মে. টন আমড়া উৎপাদন হয়। পাশাপাশি প্রায় ৯শ হেক্টর জমিতে প্র্রায় ১০ হাজার মে. টন পেয়ারা উৎপাদন হয়। এছাড়া ১ হাজার ১৫০ হেক্টর জমিতে ১০ হাজার ৩৫০ মে.টন নারিকেল উৎপাদন হয়। এছাড়া সরিষা ২২২.৭৫ মে.টন, গম ৪৭৮.৫ মে.টন, ৫ হাজার ৪ মে.টন ভূট্টা, ১২ হাজার ৮১২ মে.টন ডাল উৎপাদন হয় জেলায়। উৎপাদিত এসব সবজি, ধান ও রবি শষ্য স্থানীয় পর্যায়ে বিক্রির সুযোগ না থাকায় বাধ্য হয়ে পাইকারদের কাছে স্বল্প মূল্যে বিক্রি করতে হতো কৃষকদের। কিন্তু এখন পদ্মা সেতু চালু হবার সাথে সাথে এ সমস্যার সমাধান হওয়ায় কৃষকরা অধিক লাভবান হবে। কৃষকরা জানায় সেতু চালু হবার সাথে সাথে তাদের এসব কৃষিপণ্য দ্রুত সময়ের মধ্যে ঢাকায় সরবরাহ করা সম্ভব হবে। সেখান থেকে চলে যাবে চাহিদা ভিত্তিক অঞ্চলে সরাসরি।
ঝালকাঠির সবজী সমৃদ্ধ এলাকা গাভারামচন্দ্রপুর ইউনিয়নের গাভা গ্রামের কৃষক মো. জালাল হোসেন, তেরআনা গ্রামের নূর আলম ও হোসেনপুর এলাকার কৃষক সুজন হাওলাদার জানান, বছরের বারো মাস কৃষির উপর নির্ভশীল তাদের জীবন জীবিকা। বিশেষ করে সবজির পাশাপাশি ধান আবাদও হয় প্রচুর। এসব সবজির মধ্যে কাঁচকলা, কাঁচামরিচ, কুমড়া, নারিকেল, আমড়া, পেয়ারা উল্লেখযোগ্য। ধান আবাদের চেয়ে সবজি আবাদ করে বেশি লাভবান হওয়ায় তারা অনেকেই এখন ক্রমান্বয়ে সবজি চাষে ঝুঁকে পরছে। সেতুর কারণে পাইকারদের কাছে সবজির দাম বেশি পাবে। কারণ এখন তাদের উৎপাদিত পণ্যের চাহিদা বেড়ে যাবে। আগে এ ইউনিয়নের উৎপাদিত কৃষিজাত মালামাল পার্শবর্তি এলাকা ছাপিয়ে বরিশাল পর্যন্ত যেত। এখন ৩ ঘন্টার ব্যবধানে তা ঢাকায় সরবরাহ করে অধিক মুনাফা অর্জন করা সম্ভব হবে। বিশেষ করে পাইকাররা কৃষকের কাছ থেকে এসব পন্য দ্রুত কিনে দ্রুত ঢাকা সরবরাহ করতে পারবে। এতে করে এখন তাদের উৎপাদিত কৃষি পণ্য নিয়ে পচনের চিন্তা করতে হবেনা। দামও ভাল পাবার আশা কৃষকদের।
সদর উপজেলার সবজি আবাদের ডিপো বলে পরিচিত নবগ্রাম ইউনিয়নের কৃষক হরিপদ, সনজীব হালদার, কৃর্ত্তিপাশা ইউনিয়নের কৃষক স্বপন দাস, শাহজাহান মোল্লা, সনজয় চক্রবর্তি ও বিনয়কাঠি ইউনিয়নের কৃষক জামাল খলিফা ও শাহআলম খলিফার কাছে প্রশ্ন ছিল পদ্মা সেতু চালু হলে আপনাদের জীবন যাত্রা ও জীবিকায় কি প্রভাব পরবে। জবাবে এরা জানালেন, তাদের এলাকার কৃষিজাত উৎপাদিত শষ্য ধান, পাট, গমের পাশাপাশি সবজী বিশেষ করে কাকরোল, ঢেড়স, আলু, শাক, লাউ, কচুঁ, করোল্লা, পাতাকপি, ফুলকপি,বেগুন, টমেটো, লেবু ইত্যাদি। এসব পণ্যের চাহিদার চেয়ে উৎপাদন বেশি। দ্রুত পচনশীল এসব সবজি হিমাগারে সংরক্ষনের কোন ব্যবস্থা নেই। তাই জমি থেকে তুলে এনে স্বল্প মূল্যে এতো দিন পাইকারদের কাছে বিক্রি করতে হতো। এসব সবজী পার্শবর্তি এলাকা ছাড়া বিক্রি করা যেত না। এখন পদ্মা সেতু নির্মানের ফলে ৩ ঘন্টার মধ্যে পাইকাররা সবজি নিয়ে ঢাকায় পৌছাতে পারবে। এর আগে তাদের ঢাকা যেতে ফেরিতেই সময় লাগত ৩ ঘন্টা। তারা আরো জানান, এতো দিন তাদের এলাকার আমড়া ও পেয়ারা ১ দিন পর ঢাকা যেতো লঞ্চে। এখন পদ্মা সেতু পাড় হয়ে মাত্র ৩ ঘন্টায় ঢাকা পৌছে দেশের বিভিন্ন জেলায় ছড়িয়ে যাবে দিনেই।
ঝালকাঠি জেলার দূরবর্তী উপজেলা কাঠালিয়ার পাটিখালঘাটা ইউনিয়নের কৃষক সুমাইয়া রুবি, মাহাতাব উদ্দিন ও আজাদ হোসেন পদ্মা সেতুর সুবিধা প্রসঙ্গে বলেন, আগে আমাদের উপজেলা থেকে শুধু মাত্র দূরবর্তি রুটের যাত্রীবাহি ববাস চলাচল করতো। এখন সরাসরি ঢাকা থেকে পাইকাররা ট্রাক নিয়ে দিনে দিনে আমুয়া, বরগুনা ও কাঠালিয়া চলে আসবে। ট্রাকে এলাকার কৃষিজাত পণ্য বিশেষ করে ধান, চাল, ভূট্টা, সরিষাসহ রবিশষ্য নিয়ে দিনে দিনে ঢাকায় ফিরে যাবে। যা এতো দিন স্থানীয় বাজারে সামান্য কিছু বিক্রি হয়ে বেশির ভাগ অবিক্রিত থেকে যেত। কাঠালিয়া উপজেলা কৃষিসম্প্রসারন বিভাগের উপসহকারি কৃষি কর্মকর্তা মো. বশির জানান, পদ্মা সেতুর চালু হওয়ায় সাথে সাথে আমরা স্মলহোল্ডার এগ্রিকালচারাল কম্পিটিটিভনেস প্রজেক্টের (এসএসিপি) এর মাধ্যমে উৎপাদিত কৃষি পণ্য ঢাকায় বিক্রির উদ্যোগ নেয়া হবে। মাঠ পর্যায়ে কৃষকদের কাছ থেকে তাদের উৎপাদিত পণ্য সংগ্রহ করে কৃষকদের সমিতির মাধ্যমে ঢাকায় বিক্রি করা হবে। এতো দিন পদ্মা সেতু না হওয়ায় কারণে এটি সম্ভব ছিলনা বলে এই মাঠ পর্যায়ের কৃষি কর্মকর্তা এভাবেই জানালেন সেতুর সুফল। ঝালকাঠির সবজি এলাকা বাউকাঠি, জগদীশপুর, ডুমুরিয়া ও ভীমরুলীর পাইকার অমল হালদার, পলাশ মন্ডল, বিমল হালদার জানান, পদ্মা সেতু চালু হবার কথা শুনেই আমরা ঢাকা কাওরান বাজার, নারায়নগঞ্জ সহ বিভিন্ন আড়তে যোগাযোগ শুরু করেছি। তাার জানিয়েছে ট্রাকে সবজি নিয়ে এলেই সাথে সাথে বিক্রির টাকা দেয়া হবে। তবে ভোর ৫ টার মধ্যে ঢাকায় পৌছাতে হবে। যা এখন বাস্তবে সম্ভব। এছাড়া বছরের মে থেকে অক্টোবর পর্যন্ত লেবু, পেয়ারা এবং আমড়া নিয়ে সরাসরি ঢাকায় বিক্রি করা সম্ভব হবে। পাইকাররা জানায় আগে এসব ফল নিয়ে ট্রলারে বরিশাল সেখান থেকে লঞ্চে উঠিয়ে ঢাকায় পাঠাতে খরচ পড়ে যেত। এখন এক ট্রাকে বেশি নিয়ে যেতে খরচ কমবে। এতে চাষীদের আমরা দামও বেশি দিতে পারব।
ঝালকাঠি কৃষি সম্প্রসারন অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. মনিরুল ইসলাম পদ্মা সেতুর প্রতিক্রিায় বলেন, এ সেতুর প্রভাবে ঝালকাঠিতে কৃষি বিপ্লবের বিস্ফোরণ ঘটবে। কৃষক ও কৃষির উন্নয়ন তরান্বিত হবে। এর ফলে দ্রুত কৃষকের উৎপাদিত পণ্য দেশের সব বাজারে পাঠানো সম্ভব হবে। ফেরীর অপেক্ষায় কৃষি পণ্য নষ্ট ও সময় ক্ষেপন হবেনা। কৃষকের নগদ ও ন্যায্য মূল্য প্রাপ্তি নিশ্চিত হবে। বাকিতে পাইকারের কাছে বিক্রি করতে হবেনা। বিশেষ করে সবজি, আমড়া ও পেয়ারার বাজার তরান্বিত হবে।
পদ্মা সেতু চালুর পর ঝালকাঠি জেলার কাঠালিয়া উপজেলার বিষখালী নদী তীরে গড়ে উঠা পর্যটন এলাকা ছৈলারচর হতে পারে দক্ষিণাঞ্চলের অন্যতম দর্শনীয় স্পট। এমনটাই মনে করেন জেলা প্রশাসক মো.জোহর আলী। একই সাথে তিনি তার প্রতিক্রিয়ায় জানান, ঝালকাঠির ব্রান্ড পণ্য শীতলপাটি ও পেয়ারা চাষীদের এতো দিনের স্বপ্ন পূরণের দ্বার উম্মোচন হবে পদ্মা সেতুর উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে। কারণ বিশ্বের সকল পর্যটকরা এখন সরাসরি ঢাকা বিমানবন্দরে নেমে ঝালকাঠি এসে চৈলার চরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারবে। একই সাথে সরাসরি ন্যায্য মূল্যে বেশি করে কিনে নিতে পারবে ঝালকাঠি পাটিকরদের হাতে তৈরী শীতলপাটি। সেই সাথে পদ্মা সেতুর প্রভাবে এ জেলায় ঘটে যাবে কৃষি বিপ্লব। সেতুর কারণে চাহিদা অনুযায়ী জেলার কৃষি পণ্য বিশেষ করে সবজি দ্রুত সময়ের মধ্যে ঢাকায় সরবরাহ করা সম্ভব হবে। এতো দিন কৃষকের এসব পণ্য সামান্য বিক্রি হবার পর অনেকটা পচে এবং কিছু অংশ অবিক্রিত থাকায় লাভের চেয়ে ক্ষতি বেশি হতো।

সংবাদ প্রকাশঃ  ২৪-০-২০২২ইং সিটিভি নিউজ এর  (সংবাদটি গুরুত্বপূর্ণ মনে হলে দয়া করে ফেসবুকে লাইক বা শেয়ার করুন) (If you think the news is important, please share it on Facebook or the like  See More =আরো বিস্তারিত জানতে ছবিতে ক্লিক করুন=  

(সংবাদটি গুরুত্বপূর্ণ মনে হলে দয়া করে ফেসবুকে লাইক বা শেয়ার করুন)
(If you think the news is important, please like or share it on Facebook)
আরো পড়ুনঃ