নারায়ণগঞ্জে গ্যাসের লিকেজে দুর্ঘটনায় ঘটছে একের পর এক প্রানহানি

সিটিভি নিউজ, এম আর কামাল, নারায়ণগঞ্জ থেকে জানান : রান্না ঘরে গ্যাসের সিলিন্ডার কিংবা তিতাসের প্রাকৃতিক গ্যাসের লাইনের কোথাও লিকেজ। সেখান থেকেই অবিরত বের হতে থাকে গ্যাস। গৃহীনিরা অনেকেই এ গ্যাসের গন্ধ শুকতে অভ্যস্ত। কিন্তু দরজা জানালা বন্ধ থাকার কারণে কখনো সেই গ্যাস ক্রমশ বদ্ধ ঘরগুলোতে থেকে যায়। তখনই হঠাৎ চুলা জ্বালাতে দিয়াশলাই কিংবা ম্যাচলাইট চাপ দিলেই ঘটে যায় ভয়াবহ ঘটনা। আগুন ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। ঘটে বিস্ফোরণে। রান্নাঘর থেকে শুরু কর যেখানেই থাকে গ্যাসের প্রকোপ সেখানেই মুহূর্তের মধ্যেই আগুন ধরে যায়। ঘটছে একের পর এর প্রাণহানি। তবে যারাই মারা যান তাদের মৃত্যুযন্ত্রণায় কাঁতরাতে হয়। হাসপাতালের বিছানায় কষ্টের করুণ মৃত্যু হচ্ছে তাদের।
গত কয়েক মাসে নারায়ণগঞ্জে বেশ কয়েকটি দুর্ঘটনা ঘটেছে। অনেকের প্রাণ গেছে। কেউ আবার দুর্ঘটনায় আহত হয়ে কাঁতরাচ্ছেন। অনেকেই অসহায় হয়ে পড়েছেন। আহত হয়ে মৃত্যু শয্যায় কেউ কেউ। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রাকৃতিক গ্যাস অনেক নিরাপদ। বিশেষ করে পাইপ লাইনে যেটা সরবরাহ হচ্ছে। কিন্তু দুর্ঘটনার পেছনে মূল কারণ অসচেতনতা। আর সে কারণেই দুর্ঘটনাগুলো ঘটছে।
সংশ্লিষ্ট তিতাস গ্যাসের কর্মকর্তারা বলছেন, রাতে চুলার চাবি চেক করা প্রয়োজন। তাছাড়া প্রতিবার চুল ধরানোর আগে রান্না ঘরের জানালা বা দরজা খুলে নেওয়া উচিত। জানালা খোলার কমপক্ষে ৫ মিনিট পর চুলা ধরালে ঝুঁকি কম থাকে। সাধারণত রুমের চারদিক বন্ধ থাকলে গ্যাস লিকেজ থাকলেও বের হতে পারে না। তখন দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। সবশেষ শহরের পশ্চিম মাসদাইর এলাকায় ফ্ল্যাটে সিলিন্ডার থেকে গ্যাস লিকেজ হয়ে বিস্ফোরণের ঘটনায় চারজনের মৃত্যু হয়েছে।
৮মার্চ সোমবার রাত সাড়ে ১২টার দিকে শহরের পশ্চিম মাসদাইর এলাকায় হাজী ভিলার ছয়তলার ফ্ল্যাটে বিকট শব্দে বিস্ফোরণে একই পরিবারের ছয়জন দগ্ধ হয়। বিস্ফোরণে ওই ঘরের দরজা-জানালার কাঁচ ভেঙে গেছে এবং ঘরের আসবাবসহ বিভিন্ন মালামাল পুড়ে যায়। দগ্ধ ব্যক্তিদের উদ্ধার করে রাজধানীর শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক ইনস্টিটিউটে ভর্তি করা হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় পরদিন মঙ্গলবার মো. মিশাল মারা যান। বৃহস্পতিবার মারা যান মিশালের চাচাতো ভাই মাহফুজ।
ফায়ার সার্ভিস জানিয়েছে, গ্যাস সিলিন্ডারের মুখ থেকে গ্যাস লিকেজ হয়ে পুরো গ্যাস ঘরে জমেছিল। বিদ্যুতের স্পার্ক অথবা মশার কয়েল জ্বালাতে গিয়ে এ বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে।
এর আগে গত ৪ সেপ্টেম্বর ফতুল্লার পশ্চিমতল্লা এলাকার আলোচিত বাইতুস সালাত জামে মসজিদে গ্যাসের লিকেজের জমে থাকা গ্যাসের আগুনে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। আর এই ঘটনায় দগ্ধ অবস্থায় ৩৭ জনকে জাতীয় শেখ হাসিনা বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ভর্তি করা হয়। এদের মধ্যে একে একে ৩৪ জন মারা গেছেন। সেই মসজিদের ভেতর দিয়ে গিয়েছিল একটি গ্যাসের লাইন। সেটা লিকেজ হয়ে মসজিদের ভেতরে গ্যাস ভরে থাকতো। বিদ্যুতের স্পার্কে সেই মসজিদের ভেতরেই অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে।
এর আগে সিদ্ধিরগঞ্জে ফ্ল্যাট বাসায় গ্যাসের আগুনে বিস্ফোরণ ঘটে। মারা যান কয়েকজন। আগুনের ঘটনায় মা নূরজাহান বেগম (৭০), ছেলে কিরণ ( ৫৫) ও নাতি আবুল বাশার ইমন (২৮) মারা গেছেন। ওই সময়ে কয়েকজনের অবস্থা আশংকাজনক ছিল। ভোর ৫টায় রান্না ঘরে গ্যাসের চুলায় আগুন ধরাতে গেলে জমে থাকা গ্যাসের বিস্ফোরণ হয়। রাতে রান্নার চুলা বন্ধ না করে ওই পরিবারের লোকজন ঘুমিয়ে পরে। ফলে চুলা থেকে গ্যাস বের হয়ে ঘরের ভেতর জমে থাকে। ভোর ৫টায় রান্না ঘরে গ্যাসের চুলায় আগুন ধরাতে গেলে জমে থাকা গ্যাসের বিস্ফোরণ হয়। এতে একই পরিবারের ৮জন দগ্ধ হয়। দগ্ধদের স্থানীয়রা উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করে। তাদের বাড়ি নরসিংদী শিবপুর উপজেলার কুমড়াদি গ্রামে। সাইনবোর্ডে নরসিংদী গার্মেন্টস নামে একটি গেঞ্জির কারখানা আছে তাঁদের। আর ওই কারখানারই শোরুম ঢাকার গুলিস্তানের ঢাকা ট্রেড সেন্টারের আন্ডারগ্রাউন্ডে।
গত বছরের ডিসেম্বরে সদর উপজেলার ফতুল্লার উত্তর ইসদাইর গাবতলী এলাকায় আগুনে একই পরিবারের স্বামী স্ত্রী ও সন্তানসহ ৩ জন দগ্ধ হয়। বাড়িওয়ালা ইয়াসিন মিয়া জানান, আগুনের সূত্রপাত বলতে পারিনা। তবে মশার কয়েল থেকে হতে পারে। আগুনে দগ্ধ রেজা কাজী (৪৫) তার স্ত্রী জমিলা খাতুন (৩৫) ও তাদের মেয়ে মিতু আক্তারকে (১৫) আশঙ্কাজনক অবস্থায় উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠানো হয়।
গত নভেম্বরে সদর উপজেলার দাপা ইদ্রাকপুর এলাকায় মশার কয়েল ধরাতে গেলে রুমের মধ্যে আগুন লেগে একই পরিবারের তিনজন দগ্ধ হয়। তারা হলেন স্বামী দীপায়ন সরকার (৩৫), স্ত্রী পপি সরকার ও তাঁদের মেয়ে দিয়া রানী সরকার (৫)। শনিবার রাতে দীপায়ন ও দিয়া ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্রাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায়।
দগ্ধ পপি সরকারের বরাত দিয়ে দীপায়নের বড় বোনের জামাতা সুসেন সরকার বলেন, শুক্রবার মধ্য রাতে গ্যাস লাইটার দিয়ে মশার কয়েল ধরাতে গেলে রুমের মধ্যে আগুন লেগে যায়। এসময় তাদের চিৎকারে প্রতিবেশিরা এসে আগুন নিভিয়ে তাদের উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে আসে।
গত মার্চে সোনারগাঁও উপজেলার কাঁচপুর ইউনিয়নের সোনাপুর এলাকায় হাজী গুলজার হোসেনের একতলা বাড়ির একটি ফ্ল্যাটে গ্যাসের লিকেজ থেকে বিস্ফোরণে ভাড়াটে দম্পতি আশরাফুল ইসলাম ও তার স্ত্রী রোজিনা মারাত্মকভাবে দগ্ধ হন। আশরাফুলের শরীরের ৭৩ শতাংশ ও রোজিনার ৬৩ শতাংশ পুড়ে যায়। পরে আশংকাজনক অবস্থায় তাদের ঢাকা মেডিকেলের বার্ণ ইউনিটে ভর্তি করা হয়। দগ্ধ আশরাফুলের (৪১) মৃত্যু হয়। ১৫ মার্চ রবিবার সকালে ঢাকা মেডিকেলের বার্ণ ইউনিটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান।
স্থানীয়রা জানান, শুক্রবার রাতে রান্নাঘরের চুলার বার্ণার বন্ধ না করেই তারা ঘুমিয়ে পড়েন। ফলে সারারাত গ্যাস বের হয়ে পুরো ফ্ল্যাটে ছড়িয়ে পড়ে জমাট বেধে থাকে। শনিবার ভোরে রোজিনা সকালের নাশতা তৈরি করতে রান্নাঘরে গিয়ে চুলায় আগুন ধরালে বিকট শব্দে জমাট গ্যাসের বিস্ফোরণ ঘটে। এসময় পুরো ঘরে আগুন ধরে গিয়ে রোজিনা ও তার স্বামী আশরাফ মারাত্মক দগ্ধ হন। বিস্ফোরণের শব্দ পেয়ে পাশের ফ্ল্যাটের লোকজন ও এলাকাবাসী এসে দগ্ধ দম্পতিকে উদ্ধার করে প্রথমে স্থানীয় একটি হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখান থেকে তাদের ঢাকা মেডিকেলের বার্ণ ইউনিটে ভর্তি করা হয়। আগুনে তাদের দুইজনের গায়ের পোশাক ও বিছানাপত্রসহ ঘরের সমস্ত আসবাবপত্র পুড়ে যায়।
গত জানুয়ারীতে ফতুল্লার কায়েমপুরের মুফতি নজরুল ইসলামরে তিন তলা বাড়ির নিচ তলার ফ্ল্যাটে ভাড়া থাকতেন শরিফ ও ফরিদা। আর দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলায় এবং ছাদে টিনের ঘর তৈরি করে সেখানে জামিয়া দারুস সালাম নামে মাদ্রাসা দিয়েছেন বাড়ির মালিক মুফতি নজরুল ইসলাম। ভোরে বিকট শব্দে বিস্ফোরণের পর আশপাশের লোকজন এগিয়ে এসে খোঁজ খবর নিতে চাইলেও বাড়ির ম্যানেজার আব্দুল ওহাব মিয়া কাউকে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করতে দেননি। পরে চিৎকার শুনে জোর করে লোকজন ভেতরে ঢুকে দগ্ধদের উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যায়। তাদেরকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে স্থানান্তর করা হয়েছে। ৮ জানুয়ারি সকাল পৌনে ১২টার সময় ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ফরিদা শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
সিদ্ধিরগঞ্জে একটি ফ্ল্যাটে গ্যাসের চুলা থেকে জমা থাকা গ্যাস বিস্ফোরণে অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে। পাইনাদী সিআইখোলার ছয়তলা ইতালি ভবনের দ্বিতীয় তলায় এ ঘটনা ঘটে। এতে স্বামী-স্ত্রীসহ একই পরিবারের তিন জন দগ্ধ হয়েছেন। ফায়ার সার্ভিস ও স্থানীয় লোকজন জানায়, পাইনাদী সিআইখোলা এলাকায় সুফিয়া বেগমের ইতালি ভবনের দ্বিতীয় তলার একটি ফ্ল্যাটে কবির হোসেন তার পরিবার নিয়ে বসবাস করেন। বৃহস্পতিবার ভোরে চুলা জ্বালানোর জন্য ম্যাচের কাঠি জ্বালালে ওই ফ্ল্যাটে জমে থাকা গ্যাস বিকট শব্দে বিস্ফোরিত হয়। এতে রান্নাঘরসহ তিন ঘরেই আগুন ধরে যায়। আসবাবপত্র পুড়ে যায়। বাসার সব দরজা ও থাই গ্লাস ভেঙে যায়।
আদমজী ইপিজেড ফায়ার সার্ভিসের সিনিয়র স্টেশন অফিসার মো. শাহজাহান জানান, ধারণা করা হচ্ছে গ্যাসের চুলার গোড়ায় পাইপে লিকেজ ছিল বা চুলা বন্ধ না করেই পরিবারের লোকজন ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। এতে রাতভর দরজা-জানালা বন্ধ থাকায় বাসায় ভেতরে গ্যাস জমে যায়। ভোরে কেউ চুলা জ্বালাতে গেলে এ বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। এতে বাসার ভেতের আগুন ধরে গেলে একই পরিবারের তিনজন দগ্ধ হয়।

সংবাদ প্রকাশঃ  ১৪২০২১ইং (সংবাদটি গুরুত্বপূর্ণ মনে হলে দয়া করে ফেসবুকে লাইক বা শেয়ার করুন) (If you think the news is important, please share it on Facebook or the like সিটিভি নিউজ@,CTVNEWS24   এখানে ক্লিক করে সিটিভি নিউজের সকল সংবাদ পেতে আমাদের পেইজে লাইক দিয়ে আমাদের সাথে থাকুনসিটিভি নিউজ।। See More =আরো বিস্তারিত জানতে লিংকে ক্লিক করুন=   

(সংবাদটি গুরুত্বপূর্ণ মনে হলে দয়া করে ফেসবুকে লাইক বা শেয়ার করুন)
(If you think the news is important, please like or share it on Facebook)
আরো পড়ুনঃ