নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশেনের বছর বছর বাজেট বাড়লেও ভোগান্তি কমেনি নগরবাসীর

সিটিভি নিউজ, এম আর কামাল, নারায়ণগঞ্জ থেকে জানান : নারায়ণগঞ্জের সিটি করপোরেশনের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও পয়নিষ্কাশন খাতে বছরের পর বছর ব্যয় বাড়লেও শহরের পরিচ্ছন্নতায় নেই উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন। শহরের প্রধান সড়কসহ ওয়ার্ডের অলিতে গলিতে দিনভর পড়ে থাকে আবর্জনা। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের আবর্জনা সড়কে স্তূপ করে রাখা হয়। রাস্তায় বের হলে নাকে রুমাল চেপে চলাচল করতে হয় পথচারীদের। শহরের বাহিরে সিদ্ধিরগঞ্জ কিংবা বন্দরের কদমরসূল অঞ্চল নয় নারায়ণগঞ্জ অঞ্চলেও রাস্তার পাশে ময়লা-আবর্জনা পড়ে থাকাই হয়ে উঠেছে স্বাভাবিক ঘটনা।
শহরকে পরিচ্ছন্ন রাখতে সিটি করপোরেশন দুই বছরে ২৬ কোটি ৩৯ লাখ ৭৬ হাজার ৮০০ টাকা খরচ করেছে। এত টাকা খরচের পরও শহরের বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় আশানুরূপ উন্নতি দেখা যাচ্ছে না। সিটি করপোরেশনের প্রতিটি ওয়ার্ডের অধিকাংশ সড়কগুলোই যেন ছোট ছোট ময়লার ভাগাড়। প্রতি
নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের সূত্রমতে, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও পয়নিষ্কাশন খাতে ২০২২-২০২৩ অর্থ বছরের বাজেট ছিল ১৭ কোটি ৭০ লক্ষ টাকা। গত বছরে এই খাতে খরচ ছিল ১৩ কোটি ১০ লক্ষ ৮৩ হাজার ৪২৬ টাকা। এর আগের বছর খরচ হয় ১৩ কোটি ২৮ লক্ষ ৯৩ হাজার ৩৭৪ টাকা।
বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও পয়ঃনিষ্কাশন খাতে গত বছর খরচ হয়েছে মোট ১৩ কোটি ১০ লাখ ৮৩ হাজার ৪২৬ টাকা। যার মধ্যে নর্দমা ও ময়লা-আবর্জনা পরিষ্কার বাবদ খরচ হয়েছে ১ কোটি ২৭ লাখ ১৮ হাজার ৫৯৬ টাকা, দৈনন্দিন ময়লা-আবর্জনা পরিষ্কারের উপকরণ ক্রয় করতে খরচ ৮৬ লাখ ৮০ হাজার ৪৩৪ টাকা, কঞ্জারভেন্সি যানবাহনের জ্বালানী খাতে খরচ ২ কোটি ৯১ লাখ ৫৭ হাজার ৭৬২ টাকা, ট্রলি, ভ্যান ক্রয় ও মেরামত ৭ লাখ ৬৬ হাজার ৫২৪ টাকা, কঞ্জারভেন্সি যানবাহন মেরামতে খরচ ৩৬ লাখ ২৩ হাজার ২৯০ টাকা, সুইপারদের পারিশ্রমিক বাবদ খরচ ৭ কোটি ৬১ লাখ ৩৬ হাজার ৮২০ টাকা।
স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) আইন অনুযায়ী, সিটি করপোরেশনের প্রধান কাজগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো, বর্জ্য সংগ্রহ অপসারণ।
এদিকে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের বর্জ্য নিয়ে রয়েছে একাধিক আধুনিক ব্যবস্থাপনা প্রকল্প। কিন্তু বর্তমানে শহর পরিচ্ছন্নতায় নেই পর্যাপ্ত ব্যবস্থপনা। সকাল ৯টার মধ্যে পুরো সড়কের বর্জ্য অপসারনের নিয়ম থাকলেও দুপুর পর্যন্ত কোন কোন এলাকায় বর্জ্য অপসারণ হয়না। আর সিদ্ধিরগঞ্জ অঞ্চলের বিভিন্ন এলাকায় দুই তিনদিনেও সড়কের উপর থেকে ময়লা-আবর্জনা অপসারণ হয় না।
সিটি করপোরেশনের তথ্যমতে, সিটি করপোরেশনে তিন অঞ্চলে ১১৪০ জন কর্মী পরিচ্ছন্নতার কাজে নিয়োজিত। যারা শহর পরিচ্ছন্নতায় কাজ করে।
সিটি করপোরেশনের নারায়ণগঞ্জ অঞ্চলের সকল ওয়ার্ডের বর্জ্য সংগ্রহ করা হলেও সড়কেই বর্জ্য পড়ে থাকে দিনের অধিকাংশ সময়। এমনকি শহরের প্রধান সড়ক বঙ্গবন্ধু সড়কের অন্তত ৫টি স্থানে আবর্জনার স্তূপ পড়ে থাকে। এছাড়াও টানবাজার, মিনাবাজার, খানপুর রোড, নবাব সিরাজউদৌল্লাহ রোড, শায়েস্তাখান রোড, ডন চেম্বার, খানপুর, নতুন জিমখানা, নিতাইগঞ্জ,মন্ডলপাড়া, বাবুরাইল, দেওভোগ,পাইকপাড়া, উকিলপাড়া, মিশন পাড়া, হাজীগঞ্জ,তল্লা সহ প্রায় সকল এলাকার একই চিত্র থাকে দিনের অধিকাংশ সময়।
সিদ্ধিরগঞ্জ অঞ্চলের শিমরাইল মোড়ে আহসানুল্লাহ সুপার মার্কেটের সামনে, শিমরাইল ট্রাফিক পুলিশ বক্সের সামনে, কদমতলী দক্ষিনপাড়া ভান্ডারীপুলে, চৌধুরীবাড়ি জেলেপাড়া ব্রিজের পাশে, পাঠানতলি পিএম গার্মেন্টসের বিপরীত সড়কসহ একাধিক স্থানে বর্জ্যরে বিশাল স্তূপ দেখা যায়।
বন্দরের কদমরসূল অঞ্চল নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের এক-তৃতীয়াংশ অংশ জুড়ে রয়েছে। কিন্তু বিশাল এ এলাকায় জুড়ে নেই পর্যাপ্ত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা। এ অঞ্চলের ৯ টি ওয়ার্ডের মধ্যে কেবলমাত্র ৩টি ওয়ার্ড থেকে আংশিক গৃহস্থালি বর্জ্য অপসারন করা হয়। অন্য এলাকায় বাড়ির সামনের সড়ক, খাল, নদী হয়ে উঠেছে ডাম্পিং স্পট।
সূত্রমতে, কদমরসূল অঞ্চলের ২১, ২২ ও ২৩ নং ওয়ার্ড থেকে সিটি করেপারেশেনের নির্ধারিত সংস্থা ও ব্যক্তিরা বর্জ্য সংগ্রহ করছে। এছাড়া বাকি ওয়ার্ডে আনাচে-কানাচে সর্বত্র ফেলা হচ্ছে কঠিন ও তরল বর্জ্য। ফলে ছোট-বড় বর্জ্যেরে ভাগাড়ে পরিণত হচ্ছে এসকল ওয়ার্ড। এদিকে সিটি করপোরেশনের বর্জ্য ১৮ নং ওয়ার্ডের আলআমিন নগরে ফেলার নির্দেশনা থাকলেও সেখানে প্রতি ওয়ার্ডের আশেপাশে ওই অঞ্চলের বর্জ্য ফেলা হয়।
শহরের সড়ক ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান থেকে সংগ্রহ করা বর্জ্য সেকেন্ডারি ডাম্পিং স্টেশনে (অস্থায়ী বর্জ্য স্থানান্তর স্থানে) জমা করা হয়। সেখান থেকে বর্জ্য মূল বর্জ্যের ভাগাড়ে নেওয়া হয়। কিন্তু যেসব ওয়ার্ডে সেকেন্ডারি ডাম্পিং স্টেশন নেই, সেখানে বর্জ্য উন্মুক্ত স্থানে ফেলে দেওয়া হয়। সিটি করপোরেশনের অভ্যন্তরে রয়েছে ২০টি অধিক সেকেন্ডারি ডাম্পিং স্টেশন। চাষাড়া শহর উপ-ডাকঘরের সামনে, রিজিয়া ক্লিনিকের পাশে, ভিক্টোরিয়ার বিপরীতে স¤্রাট গার্মেন্টসের পাশে, নিতাইগঞ্জের মোড়, শীতলক্ষ্যার মোড়, খানপুর হাসপাতালের বিপরীতে স্টাফ কোয়াটারের সামনে, চিল্ডেন পার্কের পাশে, হকার্স মার্কেটের পাশে, কুমুদিনীর গেটের পাশে, মেট্রো হলের বিপরীতে, টানবাজারের সুইপার কলোনির মোড়ে, ১ নং রেেেলগটের রেলওয়ে স্টেশনের কাছাকাছি স্থানে, ২ নং গেইট মোড়ের সড়ক, দিগুবাবু বাজারের ভিতরে বর্জ্য ডাম্পিং করা হয়েছে।
সিটি করপোরেশনের অধিকাংশ ওয়ার্ডেই এ রকম কিছু জায়গা নির্ধারিত রয়েছে। এসব স্থান থেকে ট্রাকে করে সেগুলো অপসারণ করে সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্ন কর্মীরা। তবে নির্ধারিত সময়ে বর্জ্য সংগ্রহ না করায় সারা দিন ধরে রাস্তার ওপরের এসব ময়লার স্তূপ দুর্ভোগ বাড়াচ্ছে মানুষের। কোনো কোনো এলাকায় রাস্তার পাশে আবার কোনো এলাকায় রাস্তার ওপরেই ময়লার স্তূপ করা হচ্ছে। বৃষ্টি হলে এসব বর্জ্য আরও বেশি ছড়িয়ে-ছিটিয়ে যাচ্ছে। বর্জ্য শোধনের আধুনিক কোনো ব্যবস্থা না থাকায় দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে আশপাশে।
ভুক্তভোগী নিতাইগঞ্জ এলাকার বাসিন্দা নরুল আমিন বলেন, রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় দুর্গন্ধে বমি আসার অবস্থা হয়। আশেপাশের ক্লিনিকের ময়লা, মেডিকেলের ময়লা এখানে (ভিক্টোরিয়া হাসপাতালের বিপরীতে) রাস্তায় ফালায়। সারাদিন এখানে ময়লা পড়ে থাকে। ময়লা কখনো দুপুরে নেয়, আবার বিকালে আগের মতো ময়লা স্তূপ হয়ে থাকে।
এদিকে সিটি করপোরেশন বাসাবাড়ি থেকে ময়লা সংগ্রহ করে না। নাসিকের অনুমতি প্রাপ্ত বিভিন্ন এনজিও এবং ব্যক্তি মালিকানায় চলছে গৃহস্থালি বর্জ্য সংগ্রহ। তবে সিটি করপোরেশনের বর্জ্য সংগ্রহে ধার্যকৃত বিলের ৫-৬ গুণ ব্যবধানে মাসিক ফি সংগ্রহ করছে বলে অভিযোগ রয়েছে। সিটি করেপারেশনের সকল ওয়ার্ডের বাসিন্দাদের এ নিয়ে আক্ষেপ থাকলেও নিরুপায় হয়ে অতিরিক্ত ফি দিয়েই বর্জ্য অপসারন করছে। বছরে সিটি করপোরেশনের বর্জ্য নিয়ে হচ্ছে কোটি কোটি টাকার বাণিজ্য।
নতুন অর্থ বছরে সিটি করপোরেশনের ময়লা নিস্কাশন কর থেকে আয় হয়েছে ১১ কোটি ২১ লক্ষ ৭ হাজার ৩০০ টাকা। গত বছর হয় ১২ কোটি ৯৮ লাখ ৯৯ হাজার ২৯৫ টাকা। এর আগে এই আয় ছিল ৯ কোটি ৩২ লাখ ৪০ হাজার ৩১৪ টাকা। পর্যাপ্ত সেবা না পেলেও কর পরিশোধ করায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন ভুক্তভোগী নগরবাসী।
শহরের ২ নং গেট মোড় দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন বেসরকারি চাকরিজীবী আবির হোসেন। তিনি বলেন, ছোট বেলা থেকে এই এলাকায় বড় হয়েছি। প্রতিদিনই এই পথ দিয়ে যেতে হলে নাকে কাপড় দিয়ে যেতে হয়। গন্ধে বাঁচা যায় না। বৃষ্টি হলে সেই ময়লা আবার পানির সঙ্গে সড়কে ছড়িয়ে পড়ে, তখন তো হাঁটাই দায়। গৃহস্থালি ময়লা নেওয়ার জন্য টাকা দেই। এছাড়া সিটি করপোরেশনকেও ময়লা পরিষ্কারের জন্য টেকা দেই কিন্তু শহরের এই অবস্থা থাকে কেন?’
বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হলে বর্জ্যের চাহিদা বাড়বে বলে মনে করেন সিটির করপোরেশনের পরিচ্ছন্ন কর্মকর্তা আলমগীর হোসেন হিরণ।
তিনি বলেন, এই প্রকল্পের কাজ শুরু হলে বর্জ্যরে সমস্যা অনেকেটা সমাধান হবে। এছাড়া শহরকে পরিচ্ছন্ন করার মানসিকতা নাগরিকদের মাঝে তৈরী হলে যত্রতত্র বর্জ্য ফেলে রাখার চিত্র কমে আসবে।
নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের এই পরিচ্ছন্ন কর্মকর্তা আরও বলেন, বর্জ্য সকাল ৬ থেকে ৯টার মধ্যে অপসারনের নির্দেশ দেওয়া আছে। কোন কারণ বশত দেরি হলে সেই বর্জ্য অবশ্যই সকাল ১০ টার মধ্যে সংগ্রহ করতে হবে। বিভিন্ন স্থান থেকে শহরের বর্জ্য সেকেন্ডারি ডাম্পিং স্টেশনে স্তূপ করা হয়। সেই বর্জ্য আমাদের ট্রাক সংগ্রহ করে মূল ডাম্পিং স্টেশনে ফেলে। সড়কে বর্জ্য রাখার ডাস্টবিন (বক্স) রাখা হয়েছিল। কিন্তু এই বক্স থাকলে অন্য সমস্যা দেখা দেয়। দুই নং গেটে যানবাহনের যাতায়াতের সমস্যা হয়। এছাড়া মানুষ ডাস্টবিনের বাহিরে ময়লা ফেলে রাখে। সেটা সংগ্রহ করতে আরো সমস্যা হয়। সড়কে মেডিকেল বর্জ্য ফেলা হলে জরিমানা করার বিধান রয়েছে। সিটি করপোরেশনের লাইসেন্স প্রাপ্ত প্রতিটি স্বাস্থ্যসেবামূলক প্রতিষ্ঠানকে মেডিকেল বর্জ্য প্রিজম সংস্থাকে দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। মেডিকেল বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ তৈরীর প্রকল্প হলে এবং কঠিন বর্জ্য অপসারণ ও ব্যবস্থাপনা শীর্ষক প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে নগরী আরো পরিচ্ছন্ন ও পরিবেশবান্ধব হবে বলে আশা করছি।

সংবাদ প্রকাশঃ  ২-০-২০২২ইং সিটিভি নিউজ এর  (সংবাদটি গুরুত্বপূর্ণ মনে হলে দয়া করে ফেসবুকে লাইক বা শেয়ার করুন) (If you think the news is important, please share it on Facebook or the like  See More =আরো বিস্তারিত জানতে ছবিতে ক্লিক করুন=  

(সংবাদটি গুরুত্বপূর্ণ মনে হলে দয়া করে ফেসবুকে লাইক বা শেয়ার করুন)
(If you think the news is important, please like or share it on Facebook)
আরো পড়ুনঃ