আজ ৪ ডিসেম্বর দেবিদ্বার মুক্ত দিবস

সিটিভি নিউজ।।      মো.এনামুল হক, কুমিল্লা থেকে :      ১৯৭১ সলের রক্তেঝরা দিনগুলোতে মুক্তি ও মিত্রবাহিনীর যৌথ আক্রমনে হানাদার মুক্ত হয়েছিল কুমিল্লার বিভিন্ন অঞ্চল। তারই ধারাবাহিকতায় দেবিদ্বার এলাকা হানাদার মুক্ত হয়েছিল ৪ ডিসেম্বর। মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর যৌথ অভিযানে ওই দিন হানাদারদের বিরুদ্ধে তীব্র আক্রমন পরিচালনা করে।
মুক্তিবাহিনী কর্তৃক কুমিল্লাসিলেট মহাসড়কের কোম্পানীগঞ্জ সেতুটি মাইন বিস্ফোরনে উড়িয়ে দেয়া হয়। মিত্রবাহিনীর ২৩ মাউন্টেন ডিভিশনের জেনারেল আর,ডি হিরার নেতৃত্বে বৃহত্তর কুমিল্লায় এই অভিযান পরিচালিত হয়। মিত্রবাহিনীর একটি ট্যাংক বহর বুড়িচং ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলা হয়ে দেবিদ্বারে আসে। হানাদাররা ওই রাতেই দেবিদ্বার ছেড়ে কুমিল্লা সেনানিবাসে পালিয়ে যায়। ধীরে ধীরে মুক্তিবাহিনীর বিভিন্ন গ্রুপ দেবিদ্বার সদরের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। এরই মধ্যে মিত্রবাহিনীর ট্যাংক বহরটি দেবিদ্বার থেকে চান্দিনা রোডে ঢাকা অভিমুখে যাওয়ার সময় মোহনপুর এলাকায় ভুল বোঝাবুঝির কারনে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে গুলি বিনিময় হলে মিত্রবাহিনীর ৬ সেনা সদস্য নিহত হয়। পাক সেনারা মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধে পালিয়ে ময়নামতি ক্যান্টনম্যান্টে চলে যাওয়ার সংবাদে ৪ ডিসেম্বর ভোর থেকেই বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন গ্রুপগুলো এবং হাজার হাজার জনতা স্বাধীন বাংলার পতাকা নিয়ে উপজেলা সদর অভিমূখে আসতে থাকে এবং ‘জয়বাংলা”শ্লোগানে বিজয়ের উল্লাসে উপজেলা সদর প্রকম্পিত করে তোলে।
১৯৭১সালের স্বাধীনতা সংগ্রাম চলাকালে মুক্তিযুদ্ধে দেবিদ্বার  বাসীর অবদান ছিল অবিস্মরনীয়। মুক্তিযুদ্ধের প্রথম থেকেই ‘যুদ্ধজয়ের নেশা’ দেবিদ্বার
বাসীর মনে দানা বাঁধতে শুরু করে। তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানের প্রধান সেনাছাউনি কুমিল্লা ময়নামতি ক্যান্টনম্যান্ট সন্নিকটে থাকায় এ অঞ্চলের মানুষকে মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকেই অনেক মূল্য দিতে হয়েছে। অপর দিকে প্রায় একই ব্যবধানে ছিল ভারত সীমান্ত। ঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকার মুক্তিযোদ্ধা এবং রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দদের ভারত সীমান্ত পারাপারে একমাত্র সহজ ও নিরাপদ এলাকা ছিল দেবিদ্বার । মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধ প্রশিক্ষণ দিতে উপজেলার ফতেহাবাদ গ্রামের জমাদ্দার বাড়ি সংলগ্ন ‘নলআরা’(গভীর জঙ্গল) এবং প্রবাসী সরকারের উপদেষ্টা মন্ডলীর একমাত্র জিবীত সদস্য ন্যাপ প্রধান অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদ’র নিজ বাড়ি এলাহাবাদ গ্রামে দু’টি অস্থায়ী মুক্তিযুদ্ধ প্রশিক্ষণ ক্যাম্প প্রতিষ্ঠা করা হয়। পাশাপাশি শুভপুর গ্রামেও একটি স্যাটেলাইট মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প ছিল। এখানে প্রাথমিক যুদ্ধ প্রশিক্ষণসহ যাচাই বাছাই করে মুক্তিযোদ্ধাদের ভারতের বিভিন্ন প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে পাঠানো হতো। মুক্তিযোদ্ধাও এ অঞ্চলে অনেক বেশী। বাংলাদেশে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে দেবিদ্বার । বিগত আ’লীগ সরকারের আমলে ‘নলআরা’(গভীর জঙ্গল)’র অস্থায়ী প্রশিক্ষন। ক্যাম্পে একটি স্মৃতিফলক এবং এলাহাবাদ গ্রামে প্রশিক্ষণ ক্যাম্পের স্মৃতি রক্ষার্থে ‘চেতনায় বাংলাদেশ নামে একটি মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘর নির্মাণ করা হয়। । স্বাধীনতা ঘোষণার মাত্র পাঁচ দিনের মধ্যেই রাজধানীসহ বিভাগীয় শহরের বাইরে শত্রু সেনাদের সাথে সম্মুখসমরে প্রাণ বাজি রেখে ৩৩ বাঙ্গালীর আত্মহুতীর মধ্য দিয়ে অত্যাধুনিক অস্ত্রে সুসজ্জিত ১৫ সদস্যের পাক হায়েনাদের একটি দলকে পরাস্ত করে নিরস্ত্র বাঙালীদের প্রথম বিজয় ছিনিয়ে আনার গৌরবময় অধ্যায়ের সূচনা করে। স্বাধীনতা সংগ্রামে হানাদার বাহিনীর নৃশংস হত্যাযজ্ঞের তান্ডবের ছোঁয়া লাগেনি এমন গ্রাম দেবিদ্বারে নেই। অন্যান্য অঞ্চলের চেয়ে এ অঞ্চলটি ছিল অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। তার পরেই ছিল ভারতের সীমান্তবর্তী এলাকা ব্রাক্ষণবাড়িয়ার কসবা অঞ্চল। পাক হায়েনাদের নির্মম তান্ডবের স্বাক্ষর দেবিদ্বার সদরে সৃষ্ট গণকবর। বিগত আওয়ামীলীগ সরকার গণকবরে শায়িত শহীদদের স্মরণে একটি স্মৃতি সৌধ নির্মাণ করেন। তাছাড়া পাক সেনাদের সাথে সম্মুখসমরেও পিছিয়ে ছিলনা এ অঞ্চল। বরকামতা যুদ্ধ, ভানী এলাকার যুদ্ধ, বারুর যুদ্ধ, মহেশপুর যুদ্ধ, ধামতী ও ভূষণা যুদ্ধ উল্লেখযোগ্য।
পোনরা গ্রামে নৌ-কমান্ডো গ্রুপের উপর হামলা:
নৌ-কমান্ডো’র ল্যাপ্টেন্যান্ট মোঃ ফজলুল হকের নেতৃত্বে নৌ কমান্ডের ৫ সদস্যের একটি দল বাগিরতি নদীর তীরে ট্রেনিং শেষে ১৯৭১ সালের ১৫সেপ্টেম্বর ২নং সেক্টর কমান্ডার খালেদ মোশাররফের কাছে রিপোর্ট করলে, সেক্টর কমান্ডার খালেদ মোশাররফ তাদের জাহাজ ডুবির মাধ্যমে নারায়নগঞ্জ বন্দর অকেজো করতে ‘লিংপেড মাইন’সহ অন্যান্য সামরিক সরঞ্জামাদি দিয়ে নারায়নগঞ্জ পাঠান। ওই নির্দেশে ১৭ সেপ্টেম্বর রাতে গ্রুপ কমান্ডার নৌকমান্ডো ল্যাপ্টেন্যান্ট মোঃ ফজলুল হকের নেতৃত্বে নৌকমান্ডোর ৫ সদস্যসহ ৮ সদস্যের একটি নৌকমান্ডো দল দেবিদ্বার উপজেলার পোনরা হয়ে নারায়নগঞ্জ নৌবন্দরে হামলার উদ্দেশ্যে যাওয়ার পথে পোনরা গ্রামে রাজাকারদের সহযোগীতায় পাক সেনাদের এ্যাম্বুসের মুখমোখী হয়ে পড়েন। ওই দিন পাক সেনাদের গুলি এবং বেয়নটের আঘাতে নারায়নগঞ্জ জেলার আবু বকর এবং সমরাস্ত্র বহনকারী দেবিদ্বার উপজেলার খলিলপুর গ্রামের এক অজ্ঞাত ব্যাক্তি শহীদ হন।
দাউদকান্দি উপজেলার অধিবাসী গ্রুপ কমান্ডার নৌকমান্ডো ল্যাপ্টেন্যান্ট মোঃ ফজলুল হক, দেবিদ্বার উপজেলার এক মাত্র নৌ কমান্ডের সদস্য মোঃ আবুল হোসেন গুলিবিদ্ধ হয়ে মারাত্মক আহত হন। অপরাপর সদস্যগন যার যার মতো প্রাণ বাঁচাতে আত্ম গোপনে চলে যান। স্থানীয়রা শহীদ আবুবকরকে পোনরা চৌরাস্তার মোড়ে দাফন করেন। এবং খলিলপুরের অজ্ঞাত শহীদ’র লাশ তার স্বজনেরা নিয়ে যান। শহীদ আবু বকরের কবরটি তার পরিবারের সহায়তায় পাকা করণ করা হয়।
ভিংলাবাড়ি- জাফরগঞ্জ শ্রীপুকুরপাড় জামে মসজিদ যুদ্ধ :
৩১মার্চ কুমিল্লা-সিলেট মহাসড়কের ব্রাক্ষণবাড়িয়া থেকে অত্যাধুনিক অস্ত্রে সুসজ্জিত ১৫সদস্যের একটি পাকসেনার দল পায়ে হেঁটে, তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানের প্রধান সেনা ছাউনি বর্তমান কুমিল্লা ময়নামতি সেনানিবাসের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে। দলটি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা এলাকায় হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে ময়নামতি সেনানিবাসের দিকে অগ্রসর হওয়ার পথে কাঁকডাকা ভোরে দেবিদ্বার উপজেলার ভিংলাবাড়ি এলাকায় স্থানীয়দের হাতে অবরুদ্ধ হয়। ওই দিন সকাল থেকে সন্ধ্যানাগাত ভিংলাবাড়ি থেকে জাফরগঞ্জ শ্রীপুকুরপাড় জামে মসজিদ পর্যন্ত প্রায় ১৫কিলোমিটার সড়ক পথে যুদ্ধ চলে। অত্যাধুনিক অস্ত্রে সুসজ্জিত পাক হায়েনাদের সাথে নিরস্ত্র বাঙালীদের সম্মুখ সমরে পুরো দলটিকে পরাস্ত করে ৩৩ বাঙালী আত্মহুতিদান এবং আলফু ফকিরসহ অসংখ্য যোদ্ধার পঙ্গুত্ব বরণে করেন।
দিবসটি যথাযোগ্য মর্যাদায় পালন উপলক্ষ্যে দেবিদ্বার উপজেলা প্রশাসন, মুক্তিযােদ্ধা সংসদ, দেবিদ্বার প্রেসক্লাব’র যৌথ উদ্যোগে নানা কর্মসূচীর আয়োজন করা হয়েছে। সকাল ১০টায় র‌্যালী, মুক্তিযুদ্ধ চত্তর ও গণকবরে পুষ্পমাল্য অর্পণ, আলোচনা সভা এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে।

সংবাদ প্রকাশঃ  ০৩-১১-২০২২ইং সিটিভি নিউজ এর  (সংবাদটি গুরুত্বপূর্ণ মনে হলে দয়া করে ফেসবুকে লাইক বা শেয়ার করুন) (If you think the news is important, please share it on Facebook or the like  See More =আরো বিস্তারিত জানতে ছবিতে ক্লিক করুন=  

(সংবাদটি গুরুত্বপূর্ণ মনে হলে দয়া করে ফেসবুকে লাইক বা শেয়ার করুন)
(If you think the news is important, please like or share it on Facebook)
আরো পড়ুনঃ